স্মৃতি থেকে ফিরে দেখা: সন্তান লালনে প্রাচুর্যের প্রভাব
কিশোর বয়সে আমার একটা মন খারাপ করা ভাবনা ছিল—আমি ভাবতাম, আমি যখন আমার বাবা-মায়ের বয়সে পৌঁছাব, তখন পেছনে তাকালে কেমন লাগবে? যেহেতু এই ভাবনায় আমি খুব দ্রুত বিষণ্ণ হয়ে যেতাম, তাই এটাকে খুব বেশি পাত্তা না দিয়ে তখনকার কাজে মনোযোগ দিতাম। ইদানীং প্রায়ই সেই সময়কার কথাগুলো মনে পড়ে। আমার বাবা-মা দুইজনই বেঁচে নেই (আল্লাহ তাদের ওপর রহম করুন)। কিশোর বেলার দিকে ফিরে তাকালে বিষণ্ণতার সাথে আরও কিছু অনুভূতি যোগ হয়। অনেক অভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনে আমার বাবা-মায়ের অসাধারণ ভূমিকার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ আসে এবং আল্লাহর কাছে খুব আন্তরিকতার সাথে তাদের ক্ষমা আর মাগফিরাতের জন্য দু’আ চাইতে পারি।
ফজরের সালাতে উঠানোর জন্য আমার বাবা আমাদের সাথে যেরকম আপোসহীন অবস্থান নিতেন, তা আমাদের কাছে প্রায়ই নির্দয় মনে হতো। না, আমি কোনো মারধরের কথা বলছি না। আব্বা খুব কঠোর গলায় বলে দিতেন যে সালাতের জামাত ছুটলে বাসায় ভাত পাওয়া যাবে না এবং এই ব্যাপারে আম্মা কোনো ব্যত্যয় ঘটাতেন না। এই লেখাতে আমার আলোচনার বিষয় অবশ্য সেটা নয়। আমি ভাবছিলাম, কীভাবে সচ্ছলতা এবং প্রাচুর্য না চাইতেই সন্তান লালন-পালনে কিছু সমস্যা তৈরি করে। আমরা অনেক সময় দেখি আমাদের সন্তানেরা একটা বিষয় চাইতে থাকে এবং সেটা নিয়ে গো ধরে থাকে বা জেদ করতে থাকে। অথচ, শৈশবে/কৈশোরে আমরা কিছু চাইতে গেলেই মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন আসত, বাবা কি এটা কিনে দিতে পারবেন নাকি তার কষ্ট হবে? ফলে অনেক ইচ্ছাই ভিতরে দমিয়ে ফেলা যেত। ব্যাপারটা সহজ করার জন্য চলুন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কথা বলি। আমরা ছিলাম একটা মধ্যবিত্ত পরিবার, যেখানে আমার বাবা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছিলেন তার অবস্থান যেন আরও নিচের দিকে চলে না যায়। আমরা প্রতিদিন সকালে রুটি দিয়ে আলু ভাজি অথবা সুজি খেতাম। শুক্রবার পরোটা পাওয়া যেত এবং তার সাথে গোশতের ঝোল আর কয়েক টুকরো আলু। সকালে গোশত পাওয়া যেত না, সেটা দুপুরের বা রাতের খাবারের সাথেই থাকত। আর বাইরের খাবার বলতে কখনো মেহমান যদি কোনো মিষ্টান্ন নিয়ে আসতেন, সেটাই। আজকের সহজলভ্য বিরিয়ানি তো ছিল একটা অকল্পনীয় বিষয়। ভালো-মন্দ খাওয়ার একমাত্র অপশন ছিল কোনো আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াত; তবে সেখানেও ছিল পোলাও, রোস্ট, আর একটা ছাগলের আইটেম (কাচ্চির প্রচলন আমার ধারণা ২০০০ সালের দিকে হয়েছে)। চাইলেই বাইরের খাবার পেয়ে যাওয়ার যে চল এখন আমাদের মাঝে স্বাভাবিক হয়ে গেছে, সেটা ভাবনার অতীত ছিল। এছাড়া প্রতিদিন মাছ, গোশত, ডিম খাওয়ার চলও ছিল না। (একটা দারুণ সময়ের কথা না শেয়ার করলেই নয়—তখন গরুর গোশতের চাইতে মুরগির মাংস ছিল প্রিমিয়াম; মেহমান আসলে বাসার মুরগি জবাই করা হতো বা বাইরে থেকে এনে জবাই করা হতো)।
অন্যদিকে বছরে একবারের বেশি জামাকাপড় বা অন্যান্য জিনিস (যেমন স্কুলের ব্যাগ) পাওয়া যাবে না—এই চিন্তাও আমাদেরকে সেগুলোর ব্যবহারে সাবধানী করে তুলত। হয়ত কোনো এক সময় ‘দাগ নেই তো শিখাও নেই’ ধরনের বিজ্ঞাপনের বুলি আমাদের বাচ্চাদেরকে উৎসাহিত করেছে কাপড় নষ্ট করতে, যেন আরও বেশি চাহিদা তৈরি হয়। কাপড়ে দাগ পড়লে আমাদের মায়ের কাছে জবাবদিহি করতে হতো, কারণ দাগটা তোলা না গেলে আরেকটা নতুন কেনার সুযোগ ছিলই না। মনের সেই সাবধানী ভাব আর অপশনের ঘাটতি আমাদের (তখনকার শিশু-কিশোরদের) মনোজগতে একটা দারুণ বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছিল; আমরা আমাদের বাবা-মায়ের প্রতি ছিলাম অনেক আবেগপ্রবণ, শ্রদ্ধাশীল এবং কৃতজ্ঞ।
সচ্ছলতা এবং প্রাচুর্য আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই খুব সহজেই পরিবারের জন্য খরচ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে করে তুলছে বিলাসী ও ভোগবাদী। অনেক সময় আমাদের প্রচেষ্টা থাকলেও, বাচ্চাদের চাচা, মামা, ফুপি, খালাদের অতিরিক্ত উপহার দেওয়ার প্রবণতা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ভাবতে শেখাচ্ছে তারা খুব বিশেষ কিছু মানুষ, এবং উপহার পাওয়া তো তাদের হক। যেহেতু আগের মতো পরিবারগুলোতে বেশি সন্তান থাকে না, ফলে তারা নিজেদের না চাইতেই স্পেশাল মনে করা শুরু করে। দ্বীন শিখলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় করার ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে পারছে না, কেননা তারা মনে করে বাবার তো সামর্থ্য আছেই। এই সমস্যা তাদের নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটা বাধা তৈরি করবে, যেহেতু তারা একেবারেই পরিশ্রম করে কিছু অর্জন করতে আগ্রহী নয়। অথচ আমরা স্কুল থেকে হেঁটে ফিরে টাকা সঞ্চয় করে পছন্দের কিছু কেনার জন্য বাবা-মাকে সাহায্যের চেষ্টা করতাম।
সন্তানদের ভোগবাদী হবার প্রবণতা যে সবার পরিবারেই একই মাত্রায় আছে তা নয়; বরং কারো কিছু কম এবং কিছু বেশি। আমি চাই আমরা প্রাচুর্য থাকলেও সন্তানদের দুনিয়া থেকে সর্বনিম্ন প্রয়োজন মিটিয়ে বাকি অর্থ অন্যদের জন্য বা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মনমানসিকতা গড়ার চেষ্টা করব। এর অর্থ জোর করে গরিবের মতো চলা নয়, বরং ‘চাইলেই কিছু পাওয়া যায়’ অথবা ‘অল্প টাকারই তো ব্যাপার, নতুন কিনলে কী সমস্যা’—এই চিন্তাগুলো যেন আমাদের সন্তানদের মধ্যে বেড়ে না ওঠে। দুনিয়ার প্রতি অতি আচ্ছন্নতাকেই রাসূল (ﷺ) তাঁর উম্মাহর অধঃপতনের কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন আর ভোগবাদিতা হলো এই সমস্যার একটি মূল কারণ। আল্লাহ যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দ্বীনের উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখেন আর আমাদের যেসব মুরব্বিরা দ্বীনের উপরে বড় করেছেন, তাদেরকে দুনিয়া এবং আখিরাতে পুরস্কৃত করুন।
আবু আঈশা
১১রবিউস সানী ১৪৪৭