মুসলিম পরিবার : নারীবাদের প্রভাব
ঈদের ছুটিতে আমার মাহরাম সম্পর্কের একটি টিনএজ মেয়েকে নসীহাহ করছিলাম। সে জিপিএ ৫ পাওয়ার এই ইঁদুর দৌড় নিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত- তার পড়তে ইচ্ছে করে না। তাকে পরামর্শ দিতে গিয়ে আল্লাহর জন্য যে কোন মুবাহ কাজ সুন্দর ভাবে সমাধা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, " তুমি কী কারণে পড়ালেখা করো বলে মনে হয়? " তখন সে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললো, " মা বলেছে, পড়ালেখা না করলে স্বামীর গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবে।" আমি কিছুটা অবাক হলাম। এ কথা শুনে আমাদের অনেকেই হয়ত অবাক হবেন না; কেননা এমনটা আজকাল মুসলিম কমিউনিটির অনেক মায়েরাও বলে থাকেন। এর পিছনে হয়ত পরিবারের মহিলা সদস্যদের প্রতি মুসলিম গৃহকর্তাদের উত্তম আখলাকের অভাবকে কিছুটা দায়ী করা যেতে পারে; কিন্তু এই পরিস্থিতি (স্ত্রীদের প্রতি নমনীয় আচরণ না করা ) আমাদের নানী দাদীদের প্রজন্মের জন্যও সত্য ছিল। দাম্পত্য জীবনে কিছু মতানৈক্য থাকবে এবং সেযুগের মহিলারা সেটা নিয়েই দিনাতিপাত করেছেন। নারীবাদীরা ভিন্ন বয়ান দিতে পারে, কিন্তু আমি খুব কম নানী দাদীকেই দেখেছি (বলতে পারেন এমন কাউকে আমি পাইনি) তাদের স্বামী মারা যাওয়ার পর তারা বৃদ্ধ বয়সে নাতি নাতনিদের কাছে তাদের স্বামীর ব্যাপারে বিষোদ্গার করছেন। অথচ এই যুগে নারীরা তার স্বামীর সাথে সামান্য মতানৈক্যকেও অপমান ভাবছেন এবং তার সন্তানের মনে এই বীজ বুনছেন যে নিজের আয় রোজগার থাকলে স্বামীর সাথে এমনটি (মতানৈক্য বা মনোমালিন্য) হবে না। এটি আসলে একটি মানসিক ভ্রান্তি- কেননা এই একই নারী অবাধ মেলামেশার হারাম পরিবেশে পুরুষ বসের হাজার অপমানকেও সম্মান মনে করে গিলে ফেলছেন। এর মূল কারণ হল - আধুনিক শিক্ষা আর নারীবাদ মেয়েদের সামনে তাদের স্বামীকে উপস্থাপন করেছে একজন প্রতিযোগী হিসেবে, কাওয়াম হিসেবে নয়। এই অনুচ্ছেদ শেষ করার আগে এই তথ্যটি দিয়ে শেষ করি - উপরে উল্লিখিত টিনএজ মেয়েটির মা কিন্তু তার নিজের পরিবারে নিজেকে খুব অসুখী বলে পরিচয় দেন; তা নয়। এমনও নয় যে উনি তার স্বামীর কাছে বাহিরে কাজ করার অনুমতি চাচ্ছেন, কিন্তু তাকে তা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ , তিনি নারীবাদের বয়ানে ভরসা রেখেছেন - নিজে যা নিয়ে সুখী হয়েছেন তা বাদ দিয়ে। শায়খ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহর ৯০ এর দশকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে (এটি Ideological Attack অনুবাদ নামে পাওয়া যায় ইন্টারনেটে ) তিনি বলেছিলেন এমন একটি সময় আসবে, যখন মুসলিম মেয়েরা সুখী থাকা সত্বেও একটি অদৃশ্য অশান্তিতে থাকবে। আল্লাহ শায়খের এর দূরদর্শিতার জন্য প্রতিদান দিন।
আমার এই লেখাটির টার্গেট গ্ৰুপ হল সেই দম্পতিরা, যারা ২০০০ সালের পরে সংসার শুরু করেছেন এবং অনেকেই শীঘ্রই তাদের সন্তানদের বিয়ের মাধ্যমে শশুর শাশুড়ির ভূমিকা পালন করবেন। আমি এই লেখার শুরুতে একটি টিনএজ মেয়ে আর তার মায়ের উদাহারণ টানলেও এই কথা কম বেশি সকলেই স্বীকার করবেন যে, গত দুই যুগ ধরে আমাদের মা, চাচী, ফুপি, খালারা তাদের মায়েদের টেকসই (পরিবার টিকানোর জন্য)পন্থা বাদ দিয়ে তাদের মেয়েদের বিবাহ পরবর্তী জীবনে হস্তক্ষেপ করা শুরু করেন। আমাদের নানী দাদীরা যেখানে আমাদের মা, ফুপি, খালাদের স্বামীর সাথে রাগ করে বাপের বাড়ি এলে রাত হওয়ার আগেই ফেরত পাঠাতেন স্বামীর কাছে, সেখানে আমাদের মা, চাচী, ফুপি, খালারা (অবশ্যই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)তার ঠিক উল্টো অবস্থান নিয়েছেন। স্বামীকে প্রতিযোগী হিসেবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে, উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করার জন্য সন্তান নিতে দেরি করার পরামর্শ, স্বামীর আয় রোজগার কত টুকু কোথায় খরচ হবে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা এমন কি বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হবে কি সিজার - এই সব বিষয়েই মেয়েদের মায়েরা তাদের সংসারে হস্তক্ষেপ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কিছু কাজ করার সুবাদে আমি বুঝতে পারি যে এখন সংসার ভাঙার যে স্রোত, তাতে মায়েদের এই আচরণের ভূমিকা কম নয়। আমাদের মা, চাচী, ফুপি, খালাদের এই আচরণ সংশোধনে আমরা নসিহত চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এর চাইতেও গুরুত্তপূর্ণ বিষয় হল আমরা নিজেরা যেন এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসি। আমরা আমাদের সন্তানদের পরিবারগুলোতে হস্তক্ষেপ না করি। আমরা উপদেষ্টা হিসেবে তাদের জন্য থাকবো, কিন্তু তাদের উৎসাহিত করব, নিজেদের সমস্যা যেন তারা নিজেদের শোবার ঘরেই সমাধান করে। লেখাটি দীর্ঘায়িত না করে আমার নিজেকে এবং দ্বীনি ভাই বোনদের কিছু উপদেশ দিয়ে শেষ করছি।
📌 মুসলিম বিবাহিত ভাইদের অনুরোধ করছি তারা যেন তাদের স্ত্রীদের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কে ইঙ্গিত করে অপমানসূচক মন্তব্য না করেন। মনে রাখবেন, আল্লাহ আপনাকে তাদের উপর দায়িত্বশীল করেছেন এবং তাদের আপনার উপর নির্ভরশীল (অর্থনৈতিক এবং অন্নান্য বিষয়ে) করেছেন যেন আপনার বেশ কিছু প্রয়োজন এবং কাজ তারা দেখভাল করতে পারেন। অতএব, আপনার পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের (যারা আপনার স্ত্রীর মতন পর্দাও করেন না এবং বাহিরে হারাম পরিবেশে কাজ করেন) সামনে এই ধরণের মন্তব্য করবেন না, “ অমুকের মা (আপনার স্ত্রী), তুমি চুপ থাকো, আয় রোজগার তো করনা , দুনিয়া বুঝ কিছু? উনাকে (আপনার বোন বা অন্য আত্মীয়া) কথা বলতে দাও। উনি চাকুরী করেন।” এটি পরিত্যাগ করা খুব জরুরি কেননা এই ধরণের মন্তব্য আমাদের দ্বীনি বোনদের মনে শয়তানকে নারীবাদী বয়ানের উস্কানি দেওয়ার সুযোগ তৈরী করে দেয়।
📌 বোনদেরকে অনুরোধ করছি তারা যেন দাম্পত্য জীবনে সহনশীলতার পরিচয় দেন। স্বামীর সাথে প্রতিটি মতানৈক্যকে অপমান হিসেবে মনে করার পিছনের কারণ হল, স্বামীকে কাওয়াম হিসেবে মেনে নিতে না পারা। অনেকেই একটি কুযুক্তি পেশ করেন - স্বামীরা সাহাবীদের মতন না হয়ে আমাদের কাছে মহিলা সাহাবীদের মতন আনুগত্য প্রত্যাশা করে কেন? চিন্তা করে দেখুন একই কথা ভাইয়েরা বলা শুরু করলে প্রতিটি পরিবার ব্যার্থ হতে বাধ্য। আমাদের কে সালাফদের থেকেই নিজেদের আচার আচরণ ঠিক করার দারস নিতে হবে; এবং সেটা আমার স্বামী বা স্ত্রী করছে কিনা, তার উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। আমাদের পরস্পরের খারাপ লাগাগুলোর সময় ভালো মুহূর্তগুলোর কথা খেয়াল করে ছাড় দেওয়ার মন মানসিকতা (এটা ভাইদের প্রতি ও উপদেশ) তৈরী করতে হবে। বোনেরা বিভিন্ন পারিবারিক বিষয়ে স্বামীদের অবশ্যই পরামর্শ দিবেন, কিন্তু সেটা গৃহীত না হলে পরবর্তীতে যে সিদ্ধান্ত আপনার স্বামী নিয়েছেন, তার সাথে আপনি পূর্ণ সমর্থন দিবেন এবং সন্তানদের উৎসাহ দিবেন সেটা মেনে চলার। যেসব বোনেরা আল্লাহর জন্য ঘরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা খেয়াল রাখবেন এটি আল্লাহর জন্য নেওয়া সিদ্ধান্ত, আপনার স্বামীর জন্য নয়। বাহিরে কাজ করলে স্বামীর সাথে মতানৈক্য হবে না বা সম্মান বেশি পাওয়া যাবে, এটি একটি ভুল ধারণা। প্রচুর বোন আছেন, যারা পর্দা বিসর্জন দিয়ে বাহিরে কাজ করেও সম্মান পেতে পারেননি। তারা কেবল অলীক আত্মতুষ্টি তে ভুগেন যে, ‘আমি যেকোন সময় চাইলেই এই সম্পর্ক ত্যাগ করে নিজের মতন চলতে পারি।’ কিন্তু তা তারা আদতে করেন না - এটি ইসলামিক চিন্তা ধারা নয়। নারীবাদীরা আমাদের বুঝিয়েছে যে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা একজন ব্যবসায়ী মহিলা ছিলেন। কিন্তু এই সত্য গোপনকারীরা কখনোই বলেনা যে বিয়ের পর তিনি নিজেকে এই সব কিছু থেকেই গুটিয়ে নেন, একে একে রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ৭ টি বাচ্চার মা হয়েছিলেন এবং তাকে স্ত্রী হিসেবে সমর্থন দিয়ে গেছেন মক্কী জীবনের প্রায় পুরোটি সময়। তাই মতানৈক্য এবং মনোমালিন্য মানেই অপমান মনে করবেন না। নিজেদের ঘনিষ্ঠ সময়ে আপনার খারাপ লাগাগুলো স্বামীকে মন খুলে বলুন, আপনি কেমন আচরণ পেলে আশ্বস্ত হতেন। আশা করি ভাইয়েরা সেটা মূল্যায়ন করবেন। 🚨বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ: শারীরিক মারধর করা স্বামীর বেলায় আমার এই উপদেশ প্রযোজ্য নয়। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার বাবা, ভাইকে জানাবেন।
📌 নারীবাদের আরেকটি করাল থাবা পড়েছে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কে। এমনিতেই আমাদের এই উপমহাদেশে সুফিবাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাবে অনেক নারী পুরুষ এই শিক্ষা নিয়ে বড় হয়ে উঠেন যে দাম্পত্য সম্পর্কের কাজ গুলো খুবই খারাপ কাজ; এগুলো সন্তান নেওয়ার জন্য প্রয়োজন না হলে হয়ত না করলেই ভালো হত। এটি সুন্নাহর বিপরীত চিন্তাধারা। এই চিন্তা ভাবনার সাথে নারীবাদের প্রভাবে আমাদের বোনেরা স্বামীর অন্যতম একটি অধিকার (ঘনিষ্ঠতা) নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট সময় পর (কয়েকটি সন্তানের পর ) উদাসীন হয়ে পড়েন। অনেকেই এটিকে একটি বাজে কাজের অনুরোধ হিসেবে দেখেন এবং মনে করেন স্বামীর দ্বীনদারিতা কম বলে তিনি বেশি বেশি ঘনিষ্ট হতে চাচ্ছেন। এমন অভিযোগও আছে যে দাম্পত্য ঘনিষ্টতার অনুরোধের কারণে স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। এটি নিতান্তই দুঃখজনক এবং ইসলামিক পরিবার গুলোর প্রশান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টিতে একটি চরম বাধা। এই বিষয়ক হাদীস গুলো আমি এখানে উল্লেখ করলাম না। এর মধ্যে একটি আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং জয়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা এর সম্পর্কিত দুইটি হাদীস আছে। কারো খুঁজে পেতে কষ্ট হলে এই পোস্টে রেস্পন্স করলে আমি শেয়ার করে দেব।
আল্লাহ আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কগুলোকে আমাদের প্রশান্তির উৎস করে দিন। আমার অনুরোধ থাকবে সকল দ্বীনি ভাই বোনরা যেন নিজেদের দিকে তাকিয়ে সংশোধনী আনেন ; এই লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে এর পয়েন্টগুলো নিয়ে একজন আরেকজন কে খোঁচাচ্ছি; অথচ নিজের কোন ইসলাহ করছি না।
আবু আঈশা
৬ শাওয়াল ১৪৪৪