স্ক্রিন আসক্তি: এক অদৃশ্য জাল ও আমাদের জীবন

Jan 20, 2025 · 12 min read

স্ক্রিন আসক্তি বর্তমানে ধূমপান বা মাদকাসক্তির মতোই এক জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধূমপায়ীরা যেমন এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও ধূমপান চালিয়ে যান, কারণ তাৎক্ষণিক কোনো দৃশ্যমান ক্ষতি হয় না, তেমনি ‘ইনফিনিট স্ক্রলিং’-এ আসক্ত ব্যক্তিও এর নেতিবাচক প্রভাব জেনেও নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না। প্রায়শই ধূমপায়ীদের ‘ঈমান’ নিয়ে রসিকতা করা হয় – এই ধারণায় যে, কোনো বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে তার প্রভাব কর্মের ওপর পড়বে। অথচ, বেশিরভাগ ধূমপায়ী ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ জেনেও তাদের অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আনেন না। একইভাবে, স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে কাউকে নসিহত করতে গেলে দেখা যায়, তারা মনোযোগ দিয়ে শোনেন বটে, কিন্তু এরপর সেই স্ক্রিনেই নতুন কোনো ভিডিও দেখতে বুঁদ হয়ে পড়েন।

পারিবারিক ও অন্যান্য সম্পর্কগুলো নিয়ে কাউন্সেলিংয়ের সুবাদে স্ক্রিন আসক্তি থেকে উদ্ভূত অসংখ্য সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। কাউকে যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি প্রতিদিন আপনার স্মার্টফোনে কতক্ষণ সময় দেন?"—তাহলে প্রায় সকলেই সম্ভবত সত্যিকার বা বাস্তব সময়ের চেয়ে অর্ধেকের কম সংখ্যা বলবে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোতে কোন অ্যাপ্লিকেশনে কতক্ষণ সময় দিয়েছেন, তার একটি দৈনিক পরিসংখ্যান দেওয়া থাকে। কাউন্সেলিং সেশনে অনেকেই নিজের ফোন থেকে এই পরিসংখ্যান দেখে বাস্তবতার সাথে তাদের অনুমানের পার্থক্য দেখে আশ্চর্য হন।

স্ক্রিনে কাটানো এই দীর্ঘ সময় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কে যেমন প্রভাব ফেলছে, তেমনি সন্তানদের প্রতি উদাসীনতার কারণে তারাও অল্প বয়সে স্ক্রিনে আসক্ত হচ্ছে। এর ভয়াবহ দিক হলো, শিশুরা এমন সব বিষয়ে এক্সপোজড হচ্ছে যা তাদের মানসিক বিকারের পাশাপাশি নৈতিক স্খলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে এমন সময়ে আলেম, কাউন্সেলর বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসছেন, যখন তারা জানতে পারছেন যে তাদের সন্তান গত দুই-তিন বছর ধরে অনলাইনে কোনো অসামাজিক কাজের সাথে জড়িত।

স্ক্রিন আসক্তির সাথে ডোপামিনকে সম্পর্কিত করে একটি থিওরি দেওয়া হয়ে থাকে। এর জটিলতা শিক্ষিত মানুষদের কাছে কিছুটা খোলাসা হলেও আমার ধারণা, প্রায় ৯০% মানুষ এর অর্থ বোঝে না। এই জন্য সমস্যাটিকে আরও সরলভাবে বোঝানো প্রয়োজন। আমি এর জন্য একটি উদাহরণ দাঁড় করিয়েছি -এখন যাদের বয়স ৩৫-৪০-এর বেশি, তারা তাদের শৈশবে ক্লাস ৯-১০-এ ওঠার আগে অঙ্ক সমাধানের জন্য ক্যালকুলেটরের সুবিধা পাননি অথবা পেলেও তা বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া ব্যবহারের অনুমতি পেতেন না। এর ফলে অনেক বড় অঙ্কের যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ তারা মুখে মুখে করে ফেলতে পারতেন। সাম্প্রতিক সময়ে আপনারা একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, ক্লাস ৬-৮-এর বাচ্চাদের ক্যালকুলেটর-নির্ভরতা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় তাদের গণিতের দক্ষতাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এর মূল কারণ হলো নিজের দক্ষতা নির্মাণকে বিসর্জন দিয়ে অঙ্কের ফলাফল দ্রুত পাওয়ার জন্য ক্যালকুলেটরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

ডোপামিন আসক্তি খুব দুর্বোধ্য মনে হলে পাঠক এভাবে চিন্তা করতে পারেন যে, আমরা বিনোদন এবং তথ্যের জন্য সামাজিক সম্পর্কগুলোতে কোনো সময় না দিয়ে পুরোপুরি স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এই সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা আমাদের এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাই দেখবেন তথ্য, খবর, বিনোদন—সবকিছুর জন্যই আমাদের স্বয়ংক্রিয় পছন্দ আমাদের স্মার্টফোন।

সমস্যাগুলো আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্য, সুশৃঙ্খল আলোচনার স্বার্থে আমি নিচে কিছু কেস স্টাডি বা পরিস্থিতি তুলে ধরছি।

পরিস্থিতি ১:

আহমদ তার উচ্চশিক্ষা শেষ করে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার ছয় মাস পরেও সে যেন অফিসে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। বড় অফিসের অন্যান্য সহকর্মী দূরে থাক, ওর নিজের টিমের লোকজনের সাথেই এখনো তার কোনো উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়নি। ওর ম্যানেজারের কাছে নিজেকে অদৃশ্য মনে হচ্ছে। অথচ ওর ইউনিভার্সিটির একজন বন্ধু নাফিস একই অফিসে ওর কিছুদিন আগে যোগ দিয়েছে এবং অফিসে তার বেশ ভালো অবস্থান। নাফিসকে একদিন সে জানতে চাইল তার কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে কিনা। নাফিস হেসে আহমদকে বলল, “তুই অফিসে ঢুকিস কানে ব্লুটুথ হেডফোন লাগিয়ে, এরপর লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে বারবার ফেসবুক প্রোফাইল রিফ্রেশ দিতে থাকিস। কোনো আপডেট না পেলে লক করে আবার আনলক করে একই কাজ করিস। অফিসের কাউকে কি তুই তোর সাথে হালকা পরিচয়ের সুযোগ দিয়েছিস? আর তোর সাথে আমার লাঞ্চ করা হয় না। কিন্তু ডাইনিং স্পেসে যতবারই দেখেছি তোকে, তুই মোবাইল বুঁদ হয়ে ছিলি। সোশ্যাল রিলেশনশিপ থেকে ওয়ার্কস্পেসে অনেক কিছু শেখার থাকে, যেটা তুই তোর স্ক্রিন আসক্তির জন্য অর্জন করতে পারছিস না।”

আহমদের উপলব্ধি হলো তখন—চাকরিতে ঢোকার পর সে স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। দিনের শুরুতে এক সময় সে সকালের দোআগুলো নিয়ম করে পড়ত সারাদিনের নিরাপত্তার জন্য। সেই অভ্যাসটাও চলে গেছে তার। বাসে করে আসার সময় একের পর এক রিলস দেখছে আর নিজের মনে মনে হাসছে। সে সমস্যাটা স্বীকার করল এবং এটা নিয়ে কাজ করবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো।

পরিস্থিতি ২:

আসিফ আর ফারজানার বিয়ের বয়স এখন দুই বছরে পড়ল। দ্বীনের ব্যাপারে প্রাধান্য দিয়েই দুজন পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছে। শুরুতে বেশ ভালো চললেও ইদানীংকালে দুজনের ব্যাপারে দুজনের অভিযোগ বেড়ে চলেছে আর আগ্রহ কমছে ঠিক একই হারে। আসিফ অফিস থেকে ফিরলে স্ত্রীর কোনো মনোযোগ পায় না। ফারজানা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত থাকে—হয় ফেসবুক পোস্টে অথবা ইনফিনিট স্ক্রলিংয়ে। আসিফ তার সাথে সারাদিনের ক্লান্তিটা ফেলে দেওয়ার জন্য একটু গল্প করতে চায়, কিন্তু ফারজানা খুব ব্যস্ত থাকে। সময় যেতে যেতে আসিফও অফিসের জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিজের সময় স্মার্টফোনে ব্যয় করা শুরু করেছে। তাদের এই দূরত্বের জন্য যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়, তখন একজন আরেকজনকে পৌনঃপুনিকভাবে দোষারোপ করছে যে, একজন স্ক্রিনে ব্যস্ত থাকে বলেই আরেকজন একই কাজ করছে- কিন্তু এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ নিয়ে তারা ভাবছে না।

একদিন তাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের একজন আলেমের সাথে বসে পরামর্শ নিতে বললেন। পরামর্শ সেশনের পর তারা তাদের সমস্যা উপলব্ধি করল এবং এটা নিয়ে কাজ করতে উদ্যোগী হলো, কেননা তারা বিয়ের পরবর্তী ছয় মাসের দারুণ সময়টা সবসময় ধরে রাখতে চায়।

পরিস্থিতি ৩:

বিলকিস আর বিলাল— দুই ভাইবোন; দুজনের বয়সই দশের কম। বিলকিস বড়। তারা দুজন বাবা-মার কাছ থেকে অনেক সময় চায়। তারা চায় স্কুলের বাড়ির কাজগুলোতে সাহায্য করার বাইরেও বাবা-মা দুজনই যেন তাদের সাথে অনেক গল্প করেন; বই পড়ে শোনান অথবা পার্ক বা মাঠে খেলতে নিয়ে যান। কিন্তু মা সংসারের কাজগুলো শেষ করার পরেই মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মার কাছে গেলেই একটা বড় ধমক শুনতে হয়, “নিজে নিজে খেলতে পারো না?” বাবা অফিস থেকে আসার পরে একটু বিশ্রাম নেন। বিলকিসের বয়স ৯ বছর হলেও সে বোঝে বাবার এইটুকু বিশ্রাম খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ডিনারের টেবিলে খাবার শেষ করার পরে তারা দুই ভাইবোন যখন বাবার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে চায়, তখন তিনিও মায়ের মতো বিরক্ত হন। তিনি এই সময়টা মোবাইল ফোনে রাজনৈতিক ভিডিও দেখতে থাকেন আর ফেসবুকে বিভিন্ন জনের লেখা পড়েন। ইদানীংকালে তারা দুই ভাইবোনও বাসায় পড়ে থাকা একটা ট্যাবলেটে ইউটিউবে ভিডিও দেখা শুরু করেছে। ঈদের আগে দাদা-দাদি বেড়াতে এলে তারা বিলকিস এবং বিলালের স্ক্রিনটাইম দেখে অবাক হলেন আর ওদের বাবা-মাকে সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীনতার জন্য দোষ দিলেন। তারা দুজন বাসার সবাইকে নিয়ে এই ঈদের ছুটিতে সবার অপ্রয়োজনে মোবাইল ফোনে সময় ব্যয় করার অভ্যাস দূর করার পদক্ষেপ নিলেন এবং পারিবারিক সময় বাড়ানোর গুরুত্ব তুলে ধরলেন। এখন তারা বাবা-মা থেকে আগের চাইতে অনেক বেশি সময় পাচ্ছে আর চাইলেই যেকোনো সময় দাদা-দাদির কাছ থেকে গল্প শুনতে পারে। তারা দুই ভাইবোন আল্লাহর কাছে চাইছে যেন এমনটাই সব সময় থাকে।

পরিস্থিতি ৪:

শামস এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। তার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার সবচাইতে ছোট সহোদর ভাইটি তার চাইতে বেশ ছোট হওয়ার কারণে বাসায় অবসরে করার মতো কিছু পায় না। ফলে সে বেছে নিয়েছে স্মার্টফোনে শর্টস আর রিলস দেখা এবং বিভিন্ন পেইজে ঘুরে বেড়ানোকে। তার বড় বোনরা এই ব্যাপারে খুব কড়া ছিল। ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ হলে এবং ঘরের অন্য কাজ শেষ হলে তারা ভাইবোনরা মিলে কোনো কিছু খেলত অথবা গল্প করত। তারা দুজনই শামসকে বুঝিয়েছে স্ক্রিন আসক্তি কোনো ভালো বিষয় নয়। শুরুতে কেবল কিছু নিষ্পাপ ভিডিও দেখার নিয়তে এটা শুরু হলেও এক সময় অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়তেই হয়। শামস ধীরে ধীরে সেই পথেই এগুচ্ছে।

একদিন মেঝো আপু তার স্বামীকে নিয়ে বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। শামস সেটা জানতো না আর সেদিন সে তার মেঝো আপুর কাছে ধরা পড়ে যে সে ধীরে ধীরে মোবাইল থেকে অশ্লীল কনটেন্ট দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেঝো আপু তাকে প্রজ্ঞার সাথে নসিহত করলেন আর আল্লাহকে ভয় পেতে বললেন। এই ব্যাপারে আর কী করা যায়, সেটা নিয়ে মেঝো আপু ধীরে ধীরে মা আর বড় আপুর সাথে আলাপ করতে থাকলেন। শামসও প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ায় সহজেই ফিরে আসার পদক্ষেপ নিল।

এরকম আরও বেশ কিছু পরিস্থিতি তুলে ধরা যায়, যার সবগুলোই পাঠক তার চারিপাশে দেখতে পাবেন। কিন্তু স্ক্রিন আসক্তি আমাদের দীর্ঘ প্রবন্ধ বা বই পড়ার স্ট্যামিনাও কেড়ে নিয়েছে। তাই এই তালিকা আর দীর্ঘ করলাম না।

এখন দেখা যাক এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? খুব সহজ এবং স্বাভাবিক একটি উত্তর হলো আল্লাহর ভয়। ‘টাইম পাস’ বলে কিছু ইসলামে নেই এবং সময় একটি আমানত; এটি রিলস বা শর্টস দেখে নষ্ট করার বস্তু নয়। হাশরের ময়দানে যে কয়টি বিষয়ের হিসাব দিতে হবে, তার মধ্যে সময় একটি অন্যতম বিষয়। এরপরেও অনেকের জন্যই কিছু ব্যবহারিক টিপস দরকার, যেগুলো তাদেরকে অন্তত হালালভাবে প্রোডাক্টিভ বা ভালো সময় কাটাতে সাহায্য করবে; যেন সেই সময়গুলো ইবাদত বলে গণ্য হয়। চলুন দেখা যাক আমরা পারিবারিকভাবে কী কী উদ্যোগ নিতে পারি, যেগুলো আমাদের স্ক্রিন আসক্তি থেকে পারিবারিকভাবে উত্তরণে সাহায্য করবে।

বই পড়া:

স্মার্টফোনের এই আগ্রাসনের আগের পৃথিবীতে ফিরে গেলে আমরা দেখব পরিবারগুলোতে বই পড়ার অভ্যাস ছিল। এমন উদাহরণ আছে যে মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে শারীরিক সুস্থতার জন্য বাইরে খেলতে পাঠাতে চাইলেও অনেক সন্তানেরা বই নিয়েই পড়ে থাকত। আজকে সেই অভ্যাস প্রায় বিলুপ্ত। মূল কারণ সেই একই—তথ্য, বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ওপর অতি নির্ভরতা। সন্তানেরা যেহেতু বাবা-মাকে আদর্শ হিসেবে দেখে এবং খুব ছোটবেলা থেকে তাদের অনুকরণ করে, তাই বই পড়ার অভ্যাসকে ফিরিয়ে আনতে হলে এবং স্মার্টফোনের স্থলে সন্তানদের হাতে বই তুলে দিতে গেলে আগে বাবা-মাকেই সেটা নিজেদের করে দেখাতে হবে। একটু পিছনে গিয়ে দেখুন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যখন সরকার ইন্টারনেট অ্যাক্সেস বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন বাধ্য হয়েই অনেকেই বইয়ে মুখ গুঁজেছিলেন আবার। তাই, বিশ্বাস করুন, বই পড়ে নিজের জ্ঞান বাড়ানো আমাদের জন্য এখনো সম্ভব; কেবল আমাদের নিজেদেরকে শাসন করে বোঝাতে হবে, মোবাইল ফোনের স্ক্রিন আমার জন্য সব সময়ের অপশন নয়। পারিবারিকভাবে জীবনী, শিকার কাহিনি বা গোয়েন্দা কাহিনিও একটা নির্দিষ্ট সময় বেছে নিয়ে পরিবারের বড় কেউ অন্যদের পড়ে শোনাতে পারেন।

পারিবারিক সময়:

আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের জীবনে, এমনকি আমাদেরও, পারিবারিক সময়গুলো ছিল জ্ঞান অর্জন এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে বড়দের পরামর্শ নেওয়ার একটা দারুণ জায়গা। কিন্তু ধীরে ধীরে টিভি অনুষ্ঠান এবং পরবর্তীতে স্মার্টফোনের ব্যস্ততা পরিবারের সন্ধ্যাবেলার আড্ডা অথবা রাতে খাবারের পরে একসাথে বসে গল্প করার চর্চাকে প্রতিস্থাপন করেছে। ধীরে ধীরে আমরা সেই খাবার টেবিল দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম যেখানে সবাই তাদের মোবাইলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খাবার শেষ করে এবং একজন আরেকজনের সাথে কোনো কথা বলে না। এমনকি পুরোনো দিনের বন্ধুরা কোথাও গেট-টুগেদারে গেলেও সেখানে নিজেদের মধ্যে গল্প না করে দূরের কারো সাথে (যে সেদিন ওখানে অনুপস্থিত) স্মার্টফোন থেকে যোগাযোগ করতে থাকে।

একসাথে বই পড়া থেকে শুরু করে দাদা-দাদি বা নানা-নানিদের শৈশবের গল্প শোনার আয়োজন স্মার্টফোনের আগ্রাসন থেকে আমাদের পরিবারগুলো বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। খুব ছোটবেলা থেকে যদি আমাদের সন্তানদের কাছে এই ব্যাপারটিকে আকর্ষণীয় কিছু হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে তারা এটাকে অন্যতম একটি বিনোদনের উৎস হিসেবে ভাবা শুরু করবে এবং স্মার্টফোনের দিকে ঝুঁকবে না।

তাড়াতাড়ি ঘুমানো ও সকালের সদ্ব্যবহার

অনেকের মাথায় প্রশ্ন আসে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীরা কী করে নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন এবং একই সাথে দিনের বেলা অনেকগুলো জরুরি কাজ সম্পাদন করতেন, যার বেশিরভাগই ছিল শারীরিক কাজ। এর অন্যতম কারণ হলো তাঁরা ঈশার সালাতের পর খুব জরুরি কাজ ছাড়া জেগে থাকতেন না। এর ফলে ঘুমের সর্বোত্তম সময়ে (ডাক্তাররা যেটা রাত ৯টা থেকে রাত ৩টা বলছেন) তাঁরা ভালো ঘুম দিতেন এবং প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ পড়া তাদের কাছে খুব সম্ভব একটি কাজ ছিল। দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস কেবল আমাদেরকে তাহাজ্জুদ পড়া থেকেই বিরত রাখে না, বরং আমাদেরকে বেডরুমের ঘুমের সময় থেকে বেশ কিছু অংশ স্ক্রিনে অপচয় করতে উদ্বুদ্ধ করে। সাধারণত এই সময় আমাদের সন্তানরাও আমাদের কাছে আর সময় খুঁজে না, ফলে কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই আমরা নির্বিঘ্নে স্ক্রিনটাইম উপভোগ করতে থাকি।

যখন ইন্টারনেটের যুগ ছিল না, তখনকার দিনের একটা ঘটনা চিন্তা করে দেখুন; আপনার প্রতিবেশী অথবা আত্মীয়দের মধ্যে কোনো একটি পরিবার রাত সাড়ে দশটায় আপনাদের বাসায় এসে রাজনৈতিক আলাপ অথবা কোনো একটা রান্নার রেসিপি নিয়ে কথা বলছে, সেটা কি আমরা খুব সুস্থ চর্চা হিসেবে ভাবতাম? – অবশ্যই না। কিন্তু আজকে যখন আমরা আমাদের বেডরুমে যাই, তখন আমরা আমাদের বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন জনের একই বিষয়ক কথার উত্তর দিতে দিতে প্রায় মধ্যরাত পার করে ফেলি; কিন্তু ঘুমোতে পারি না। পরিবারগুলোতে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার শেষ করা এবং ঘুমোতে যাওয়ার চর্চা অবিলম্বে শুরু করা উচিত এবং বাবা-মায়েদের নিশ্চিত করা উচিত যে সন্তানরাও তাই করছে। এই সুস্থ চর্চা পরিবারগুলোকে বাঁচানোর জন্য একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে।

এছাড়াও, আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের জন্য সকালবেলায় বারাকা আছে বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা যখন রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাব, তখন সকালে জেগে ওঠা আমাদের জন্য আরও সহজ হবে। আমাদের দেশে যেহেতু কর্মঘণ্টা অনেক দেরিতে শুরু হয়, তাই কেউ যদি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে, তাহলে সে সকালের সময়ে অনেক প্রোডাক্টিভ কিছু করতে পারে; যেমন কুরআন অধ্যয়ন, কোনো একটি ভাষা শিক্ষা করা অথবা বই পড়া, অথবা শরীর চর্চা করা। অনেকেই যে শরীর চর্চা করতে না পারার কারণ হিসেবে সময়ের অভাবকে দেখান, তাদের জন্য তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়া এবং তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা নিয়মিত শরীর চর্চার সময় করে দিতে পারে। অনলাইনের বন্ধুদেরকে অগ্রাধিকার না দিয়ে আমাদের উচিত সকালে শরীর চর্চা করার জন্য ভালো কিছু মানুষের সাথে দলবদ্ধভাবে বের হওয়া। এটা আমাদের সোশ্যাল স্কিল গুলোকে আবার শাণিত করবে আর স্ক্রিন আসক্তি কমাবে।

বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়ানো:

আধুনিক যুগে যেমন কেউ কারো বাসায় দাওয়াত ছাড়া ঘুরতে যায় না, আজ থেকে তিন-চার দশক আগে পরিস্থিতি এমনটা ছিল না। অনেকেই একটা সুস্থ বিনোদন হিসেবে বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনের বাসায় নিয়মিত বেড়াতে যেত। অনেকেই পাড়ার মধ্যে বিকেল বেলা বেড়াতেন, যেখানে মহিলারা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেন আর তাদের বাচ্চারা একসাথে সামনের মাঠে অথবা পার্কে খেলত। আর কারো বাসায় মেহমান যদি সন্ধ্যার পরে আসতেন, তখন মেজবান পরিবার আন্তরিকভাবে তাদেরকে রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতেন বাসায় যা আছে তা দিয়ে এবং তাতে মেহমান পরিবার কোনো রকম মন খারাপ করতেন না। আজকের দিনের মতো এত অল্প আইটেম দিয়ে কী করে তাদেরকে খাবার অফার করি অথবা এত অল্প আইটেম দিয়ে আমাকে খাওয়ার অফার করল কেন—এসব প্রেজুডিস তাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে, ততই মানুষ আগের চেয়ে বেশি ফরমাল হয়েছে আর লোকেরা একে অন্যের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে এনেছে। সেই সময়টুকু দখল করে নিয়েছে স্মার্টফোনের ভিডিও এবং ফেসবুকের পোস্ট। এই আসক্তি থেকে বের হতে হলে আমাদের কমিউনিটির পরিবারগুলোর মধ্যে যোগাযোগ আরও এফেক্টিভলি বাড়াতে হবে এবং সেটাকে সহজ করতে হবে।

সন্তানদের স্ক্রিনটাইমের বিকল্প খুঁজে দেওয়া

সন্তানদের স্ক্রিন আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য কেবলমাত্র তাদের কাছ থেকে স্মার্টফোন কেড়ে নেওয়াই কোনো বিকল্প নয়; বরং তাদেরকে বিকল্প খুঁজে দিতে হবে। বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে বাস্তব পৃথিবীতে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়, সেটা তাদের শিখতে হবে এবং সেটা যে একটা সুস্থ বিনোদন হতে পারে, সেটা সন্তানদের বুঝতে হবে। এই সোশ্যাল স্কিল সন্তানদের গড়ে ওঠে না বলেই তারা খুব সহজে স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, কারণ তাদের কাছে বাস্তব পৃথিবীর মানুষদের সাথে কথা বলাকেই একটা দুষ্কর কাজ মনে হয়। এছাড়া আছে সন্তানদের শরীর চর্চা এবং আউটডোর খেলার ব্যবস্থা করে দেওয়া। সন্তানদের থেকে তাদের সারাদিনের জীবন নিয়ে গল্প শুনতে চাওয়া—যেন তারা এই শেয়ারিংটা ইন্টারনেটের পৃথিবীতে অচেনা মানুষের সাথে না করে পরিবারের মধ্যে করে।

আমরা দেখলাম, কীভাবে স্ক্রিন আসক্তি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে স্থবির করে দিচ্ছে। এই আসক্তি থেকে মুক্তি কেবল প্রযুক্তির ব্যবহার কমানো নয়, বরং আমাদের জীবনযাত্রায় এক মৌলিক পরিবর্তন আনা। আল্লাহর ভয়, সুন্নাহর অনুসরণ, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা এবং আমাদের সন্তানদের জন্য সুস্থ বিকল্প তৈরি করা—এই সবই হলো এই আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের প্রধান হাতিয়ার। আসুন, আমরা সচেতন হই এবং সম্মিলিতভাবে এই ডিজিটাল নির্ভরতার শৃঙ্খল ভেঙে সম্পর্কের উষ্ণতা, জ্ঞানচর্চার আনন্দ আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে এক ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ফিরে পাই, যেখানে সময় হবে ইবাদতের অংশ।

আবু আঈশা
৯ জিলহজ্জ ১৪৪৬

Back to top