আপনার মনের কথা বলুন

Jan 17, 2025 · 6 min read

অফিস থেকে যাওয়া একটা কর্মশালায় কর্মীরা – কেন তাদের অসন্তোষ বা প্রত্যাশার কথা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে না বলে দুপুরের খাবারের সময় অন্য সহকর্মীর সাথে আলাপ করে – সেই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল এর কারণ আবিষ্কার করা এবং কর্মীদের সঠিক কর্তৃপক্ষের সামনে কথা বলার ব্যাপারে উৎসাহিত করা। আমি নিজের মতামত দেওয়ার সময় এই প্রবণতার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়কে কারণ হিসেবে দেখালাম। এটি উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির একটি অংশ। আমাদের আচরণে এটি এমনভাবে স্থান করে নিয়েছে যে আমরা একজন ভালো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পেলেও তাকে সরাসরি নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা বলি না; বরং আশা করি উনি নিজে থেকে বুঝে নেবেন বা আমাকে প্রশ্ন করে জেনে নেবেন।

দিন শেষে রুমে এসে যখন একাকী ভাবছিলাম, তখন দেখলাম আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও কাছের মানুষগুলোর সাথে আমাদের অসন্তোষ বা চাওয়া-পাওয়ার কথা মন খুলে বলি না। অথচ এই সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিশোধের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারপরও আমরা যে কথাটি বললে আমাদের কাছের মানুষটির জন্য আমাদের সাথে সঠিক আচরণ করা সহজ হবে, সেটা বলি না। আমরা অভিমান করে বসে থাকি আর ভাবতে থাকি, “বলতে হবে কেন? ও/উনি বুঝে নিতে পারেন না?” ঠিক এই জায়গায় এসে সবার মনে হবে, এই লেখা নিশ্চয়ই দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে। এটা অবশ্যই বেশ কিছুটা সত্যি, তবে এই আচরণ কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয় – তা নয়। আমি অন্যান্য সম্পর্কগুলোতে এই ধরনের আচরণের কিছু উদাহরণ দিয়ে এই প্রবণতার সার্বজনীনতা প্রমাণ করতে চাই। ধরুন, আপনার বাসায় একজন মেহমান এসেছেন। বৈঠকখানায় আপনারা বসে আছেন। হালকা বৃষ্টি হওয়াতে আপনার ঠান্ডা লাগছে। আপনি ফ্যান বন্ধ করতে চাচ্ছেন বা কমিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এখন আপনি এ কথা সরাসরি না বলে মেহমানের উপর চাপিয়ে দিলেন একটি বোঝা; “ভাই, আপনার বোধ হয় ঠান্ডা লাগছে, ফ্যান বন্ধ করে দেই?” উনি বললেন, “নাতো, ঠান্ডা লাগছে না।” এরপর আপনার মন খারাপ কেন মেহমান আপনার সাথে সহমত হলেন না। অথচ উনি আপনার ঠান্ডার কথা জানলে খুশি মনেই ফ্যান বন্ধ করতে বলতেন। এটি একটি মজার উদাহরণ; চিন্তা করে দেখুন আমরা প্রায়শ দ্বিধার কারণে ভুলের কথাও লজ্জায় বলি না, এর ফলে বড় একটা সমস্যা হয়। কিন্তু সাথে সাথে ভুল স্বীকার করলে ভুলের প্রভাব কম হতো।

এমনি করে মা-বাবারা তাদের একমাত্র ছেলের প্রশ্ন, “মা-বাবা, আমি উন্নত জীবনের জন্য পরিবার নিয়ে বিদেশে চলে যাই? তোমরা থাকতে পারবে তো?” এর উত্তরে মনের কথা না বলে উত্তর দেন, “না বাবা, কোনো সমস্যা হবে না, তুই যা।” এরপর তাদের কষ্টের কথা তারা আত্মীয়স্বজনদের বলতে থাকেন বা না বললেও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। একইরকমভাবে বাবার মৃত্যুর পর ভাইরা যখন বোনদের জিজ্ঞেস করে, “তুই/তোরা তো ভালোই আছিস স্বামীর সংসারে, তোদের মিরাসটা ছেড়ে দিলে কি কোনো সমস্যা আছে?” তখন ইচ্ছা না থাকলেও বোনেরা বলে দেয়, “কোনো সমস্যা নাই।” পরে এই বোনেরাই বিভিন্ন সময় অধিকার বঞ্চিত হওয়ার এই কষ্ট অপাত্রে শেয়ার করেন এবং দুঃখ করেন। তাদের না বলার সুযোগ ছিল এবং ভাইরা কী মনে করবে বা মনোমালিন্য হতে পারে ভেবে – তারা মনের কথাটা বলেন না। অন্যদিকে ভাইদেরও অসৎ কাজের সৎ সাহস নেই যে বলবে, “আমি তোদের ভাগ দিতে চাচ্ছি না।” আসলে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পর্কে প্রতিশোধের ভয় না পেলেও মনোমালিন্য বা রাগের কথা শুনতে ভয় পায়। এই ভয় এতটাই বেশি যে এই জন্য তারা পরবর্তীতে ক্ষতি স্বীকার করে নিতেও প্রস্তুত থাকেন।

আসল অসন্তোষ বা চাওয়া-পাওয়ার কথা না বলে অন্য কিছু বলার এই অভ্যাসের চর্চা সবচাইতে বেশি হয় দাম্পত্য সম্পর্কে। এ নিয়ে ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক রসালো লেখা এবং ভিডিও প্রচার হয়; যেমন স্ত্রীদের বা স্বামীদের ডিকশনারি। অর্থাৎ, কোন কথার অর্থ আসলে কী? এগুলোকে সবাই খুব হালকাভাবে নিলেও এই আচরণ আমাদের অনেক দাম্পত্য সম্পর্ককে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। ভাঙনের মুখে থাকা অনেক সংসারেই স্ত্রী ভাবছেন, সে কেন আমার সমস্যাগুলো বোঝে না? এদিকে দিনের পর দিন অফিস বা কাজ সেরে এসে স্ত্রীর গোমড়া মুখ দেখে কিছু বুঝতে না পেরে ধীরে ধীরে স্বামী বিরক্ত হয়ে খারাপ আচরণ শুরু করেন। যখন তারা কাউন্সেলিং সেশনে বসেন, তখন তারা বোঝেন যে তারা একজন আরেকজনের সাথে অসন্তোষ বা চাওয়া-পাওয়াগুলো নিয়ে কথা বললে টানাপোড়েন এতদূর আসতো না। উভয়েই ভেবেছেন অন্যজন বুঝে নেবে এবং এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবে। আমি দাম্পত্য সম্পর্ক এবং মুসলিম কমিউনিটির সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই, যেখানে স্বামী-স্ত্রীদের পরিষ্কারভাবে তাদের ইচ্ছা বা প্রত্যাশা উল্লেখ করা উচিত যেন পরবর্তীতে একজন আরেকজনকে দোষারোপ না করেন।

পরিস্থিতি ১# স্ত্রীদের অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন বা কুরআন হিফজ করা বর্তমানে মুসলিম কমিউনিটির ভাইদের বোধ করি সর্বাধিক অভিযোগের বিষয়। এই পারিবারিক অশান্তিরও কারণ নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার কথা সোজা কথায় না বলা। ধরুন, বোনেরা যখন একটি ক্লাসে নিবন্ধন করেন, তখন তাদের উচিত কেবল ক্লাসের অনুমতি না নিয়ে, ক্লাসের কারণে সংসারের কোন কোন কাজ ওই সময়ে না করে পরে করা হবে তা উল্লেখ করা এবং তার অনুমতি চাওয়া। অনলাইন ক্লাসের অনুমতি দেওয়ার সময় স্বামীরা খেয়াল করেন না বা বোঝেন না যে এই ক্লাসের কারণে কী কী হতে পারে। অথচ স্ত্রী যদি বলতেন, “আমার এই ক্লাসের জন্য সপ্তাহে দুই দিন রাতে আপনার খাওয়ার সময় আমি পাশে থাকতে পারবো না, কুরআন পড়া দেব আর একদিন সন্তানদের পড়ার সময় আমি ক্লাসে থাকবো। সন্তানদের পড়ার ক্ষতিটা আমি পরে পুষিয়ে দেবো। এই ব্যাপারে কি আমি অনুমতি পেতে পারি?” তাহলে স্বামীদের জন্য অনুমতি দেওয়া যেমন সহজ হয়, তেমনি পরবর্তীতে কোনো কলহ হয় না। তবে স্বামীদের মনে যদি না বলার ইচ্ছা থাকে, তবে সেটা চেপে অশান্তির ভয়ে অনুমতি দেওয়াও সমীচীন নয়। আর এই “না” শুনে সেটা খুশি মনে না হলেও অন্তত সবরের সাথে মেনে নেওয়া স্ত্রীদের দায়িত্ব।

পরিস্থিতি#২ স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজন কে একে অপরের জন্য সুন্দর থাকা বা হওয়ার জন্য বলা দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য খুব জরুরি একটি বিষয়। এই চর্চা আরব সংস্কৃতিতে থাকলেও আমাদের মধ্যে একেবারে নেই বললেই চলে। যেমন একজন স্বামীর মন চাইছে তিনি যখন বাসায় আসেন, তখন তার স্ত্রী ভালো জামাকাপড় পরিধান করবেন, আরো সুন্দর হবেন। কিন্তু তিনি সেটি বলেন না, কারণ বললেই, স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠবে, “তার মানে আপনার এখন আমাকে ভালো লাগে না? হায় আল্লাহ আমার এখন কী হবে!!!” তাই স্বামী মন খারাপ করে থাকেন এবং সম্পর্কের অবনতি হয়। এ কথা শুনে বোনদেরও মন খারাপ করার কোনো কারণ নাই। একইরকমভাবে আপনারাও স্বামীকে আপনাদের মন মত থাকতে (নিজেদের যত্ন নেওয়া, ভুঁড়ি কমানো, কোনো রোগ থাকলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে চলা, যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি) মুখ ফুটে বলতে পারেন। সেটা না বলে মনে মনে দুঃখ করবেন না।

পরিস্থিতি #৩ এরকম আরেকটি উদাহরণ হল স্বামী-স্ত্রী যখন তাদের কোনো একজন আত্মীয়ের বাসায় যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তখন সেটা সরাসরি না বলে এমন কিছু বলেন যেটা অপর পক্ষের জন্য দূর্বোধ্য, কিন্তু তাদের প্রত্যাশা থাকে আমার স্বামী বা স্ত্রী আমার অনীহা বুঝে নেবেন। যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি এবং তাদের সন্তানদের ছাড়া আরেকটু দূর সম্পর্কের মানুষগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মীয়ের মধ্যে পরেন না। এই ক্ষেত্রে অনেক দ্বীনি ভাইবোন আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে একজন আরেকজনকে পীড়াপীড়ি করেন, অথচ ওই বাসায় হয়ত ইসলামবিদ্বেষী আচরণ করা হয় এবং আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সেখানে যেতে না বলার পুরো অধিকার আছে।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের মধ্যে আপনজনকে নিজের মনের কথা বলায় এতো দ্বিধা জন্ম নিয়েছে যে আমরা আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসি, এই কথাও বলতে আমাদের লজ্জা হয়। অনেকে আবার এটাকে পুরুষত্বের প্রমাণস্বরূপ নিয়েছেন যে তিন সন্তান, স্ত্রী বা বাবা-মার সাথে কাঠখোট্টা থাকেন। তার সন্তানেরা তার কাছে শেষ কবে এসে মাথায় হাত বুলানো বা চুমু পেয়েছে, সেটা তিনি মনে করতে পারবেন না। কিন্তু মনে আছে সেই সাহাবীর কথা, যিনি রাসূল (সাঃ) কে তার নাতিদের চুমু দিতে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, “আমার অনেক বাচ্চা, কখনো চুমু তো দেই নাই।” রাসূল (সাঃ) তখন মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর কোনো পরামর্শ কোনোভাবেই অমূলক নয়। অতএব,আপনার ভালোবাসার কথা আপনার কাছের মানুষকে ইজহার (প্রকাশ) করুন। বলুন, “আমি আল্লাহর জন্য তোমাকে ভালোবাসি।” এই কথা কেবল দ্বীনি ভাইদের জন্য নয়, এটি ব্যবহার করুন মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রীর সাথে।

অন্যদিকে এমন ব্যক্তিত্ব ধারণ করুন, যেন আপনার কাছের মানুষ সহ দ্বীনি ভাই বা বোনেরা নির্ভয়ে তার অসন্তোষ বা চাওয়া পাওয়ার কথা বলতে পারেন। বৈধ কারণে না শুনতে এবং বলতে অভ্যস্ত হোন। আল্লাহ আমাদের মধ্যেকার আল্লাহর জন্য ভালোবাসা বাড়িয়ে দিন।

আবু আঈশা
১২ রবিউস সানী ১৪৪৪

Back to top