আত্মীয়তা ও দাওয়াহ: আমাদের করণীয়

Jan 6, 2025 · 4 min read

আপন ভাই বোন বা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া নিয়ে উদাসীন থাকা অথবা নিরাশ হয়ে পড়া

বছর পাঁচেক আগের কথা। আমার বাবার এক বন্ধুর ছেলেকে (বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া) একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যকলাপে নিরুৎসাহিত করার জন্য উপদেশ দিচ্ছিলাম। লিফলেট বিলি করে সে তখন একবার জেলফেরত। ছেলেটার বেশ কয়েকটি বোন ছিল যারা ইসলামের ব্যাপারে একেবারেই কোন জ্ঞান রাখে না। তার বাবাও ছিলেন বেরেলবী আকিদায় বিশ্বাসী। বাসা থেকে বেরোনোর সময় সদর দরজায় টাঙানো পীরের ছবিকে সালাম করে তবে তিনি ঘর থেকে বের হতেন। ছেলেটিকে যখন পরিবারের সদস্যদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে কিনা-প্রশ্ন করলাম, সে তখন বিরক্ত হয়ে বলল,“এদের দাওয়াত দিয়ে কোন লাভ নেই। এরা দ্বীনের পথে আসবে না।” বাবা মা, ভাই বোন - যাদের সাথে মানুষ সব চাইতে বেশি সময় একসাথে থাকে, তাদের পিছনে সময় দিতে সে নারাজ। অথচ লিফলেট বিলি করে মানুষকে হেদায়াতের পথে আনার ব্যাপারে সে খুব আশাবাদী। সাধারণভাবে এধরনের কোন গল্প (যেকোন নসীহত যা গল্পের ছলে বলা হয়) শুনলে আমরা কখনই বিষয়টিকে নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট মনে করিনা। বরং মৃদু হেসে হতাশায় মাথা নাড়িয়ে মনে মনে বলি, “এদের ইসলামের যে কী হবে!” এই সমস্যা কিন্তু আমাদের সবার। বেশ কিছু দ্বীনি ভাই বোন গর্বের সাথে এই রকম কথা বলেন , " আমি তো আমার পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখি না। দ্বীন বুঝেনা, হারাম খায়। অনেক বুঝিয়েছি।এরা পথে আসবে না।" নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছেদ করার বৈধতা চেয়ে তারা প্রতিনিয়ত শায়খদের কাছে প্রশ্ন করেন, অথচ এর চাইতে ঢের বেশি সেক্যুলার বন্ধু বা সহকর্মীর সাথে উঠা বসা করছেন প্রতিদিন। আকিদাতে গলদ থাকা আর সেই কারণে বেশ কিছু ফরজ ইবাদতে কমতি থাকায় আমরা ভাই বোন, মামা, চাচা, খালা বা ফুফুদের একেবারে পরিত্যাগ করছি। এই কাজকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আমাদের বেশ কিছু অজুহাত ও আছে; যেমন ওই বাসায় গেলে আমার সন্তানরা বাজে ভাবে প্রভাবিত হবে, আমার স্ত্রী বাজে পরামর্শ পাবে ইত্যাদি। অথচ, রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের দাওয়াত দিতে তাদের বাসায় পরিবার সহ বেড়াতে যাওয়া আবশ্যক নয়। আমরা যদি নিজেরা আমাদের বেদ্বীন সহকর্মী বা বন্ধুদের সাথে দুনিয়াবি প্রয়োজনে উঠা বসা করতে পারি, তাহলে বেদ্বীন ভাই বোনকে বুঝানোর জন্য তাদের বাসায় যাওয়া খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। তারা হয়ত আমাদের কথায় কান না দিতে পারে, কিন্তু সহোদর আর মামা, চাচা, খালা,ফুফু কে কি এত সহজে আল্লাহর অপছন্দের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায়? অনেকে মুসাব ইবনে উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে তার ভাইয়ের কথপোকথনের উদাহরণ দিয়ে থাকেন - কিন্তু তার ভাই ছিলেন তখন কাফির যখন ভাতৃত্বের দোহাই দেওয়াতে মুসাব বলেছিলেন আনসাররা বরং আমার অধিক কাছের। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের আত্মীয়রা কিন্তু কাফির নয়। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খরচ করা সময় থেকে কিছু সময় বের করে নিয়ে নিয়মিত ফোন করলে বা অফিস ফেরার পথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে গেলে এক সময় হয়ত তারা আমাদের কথা শুনবে, ইনশা আল্লাহ। আমার খুব কষ্ট হয় যখন অনেকে পশ্চিমে স্থায়ী হওয়া ভার্সিটির বন্ধু বা কাজিনকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার অজুহাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটান; কিন্তু আপন ভাই বোনকে দাওয়াত দেওয়ার কথা আসলেই সপ্তাহ খানেকের চেষ্টা শেষেই হতাশ হয়ে পড়েন। এটা সত্য যে আমরা দ্বীনি ভাই বোনদেরকে পেয়ে খুব আনন্দিত হই এবং দ্বীনি কমিউনিটিতে বাসা নিয়ে নেওয়ার পরে ইসলামের বিধিবিধানগুলো মেনে চলার ব্যাপারে আমাদের জীবনে সহজতা আসে। আলহামদুলিল্লাহ! ফলে দ্বীনি ভাই বোনদের মধ্যে থাকতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব - এটাই স্বাভাবিক এবং উত্তম। কিন্তু ইসলাম চর্চা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই পরিবার থেকে নিজেকে একদম আলাদা করে ফেলাটা কোন ভাবেই স্বাভাবিক নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের সবার মধ্যেই শুরুতে উল্লেখ করা সেই তরুণ ছেলেটির সমস্যা কিছু-না-কিছু পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে। আমরা যখনই একটি স্থিতিশীল পরিবেশ পেয়ে যাই, তখুনি নতুন করে আর কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাই না। আল্লাহ আমাদেরকে স্বচ্ছলতা দিয়েছেন(কারো কম কারো বেশি), আমাদের সন্তানরা ইসলামিক স্কুলে পড়ছে, আমরা আমাদের অবসরে দ্বীনি ভাই ও বোনদের বাসায় যাচ্ছি দ্বীনি আড্ডায়, হালাকাতে উপস্থিত থাকছি - আর এই স্থিতিশীল জীবন পেয়ে আপন ভাই-বোন আর বাবা মা পর্যায়ের চাচা,মামা, খালা, ফুফুদের আমরা বাদ দিয়ে দিচ্ছি। আশা করি সবাই এই ব্যাপারে নজর দিবেন। আল্লাহ্ আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার গুনাহ থেকে রক্ষা করুন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লিখাতে কোন ভাবেই দাওয়াত দেওয়ার জন্য পারিবারিক অবাধ মেলামেশা হয় এমন অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়নি।

আবু আঈশা

Back to top