সালাফী দাওয়াহ মানে কি হাদীস পড়ে নতুন করে ফিকহ উদ্ভাবন করা
সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানা তাআলার যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর দ্বীনের উপরে চলার জন্য মানুষ ও জ্বীন জাতির উদ্দেশ্যে নবী রাসূলদের পাঠিয়েছেন পথের দিশারী রূপে। দরুদ ও সালাম আমাদের প্রিয় নবী মুহম্মদ সাঃ এর প্রতি যিনি আল্লাহর ওয়াহীকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। দ্বীনের এই মিশনে সাহাবী রাঃ দের ভূমিকা অনন্য। তারা রাসূল সাঃ থেকে ওয়াহীর জ্ঞান বুঝে নিয়ে তা পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তাবেয়ীন এবং তাবে-তাবেয়ীন দের যুগ থেকে শুরু করে যত আলেম এই দ্বীনের জ্ঞানকে সংকলনের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সুসংহত করেছেন, তাদের প্রতি আল্লাহ্ রহম করুন, তাদের আখিরাতকে আল্লাহ্ সুন্দর করুন। ওয়াহীর জ্ঞানের সংকলনের প্রথম প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল আবু বকর রাঃ এর যুগে কোরআনের সংকলন বা বই হিসেবে লিপিবদ্ধ করা। এরপর যতই সাহাবীরা রাঃ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে থাকলেন, ততই ওয়াহীর আরেকটি অংশ (হাদীস) ঝুঁকির মুখে পড়ে। এই সময় হাদীস সংকলনের প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং এই বিষয়ক জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। এই প্রচেষ্টা এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ইতিহাস মুসলিম হিসেবে সবার জানা থাকা জরুরি। কেননা, এই বিষয়ক জ্ঞানের অভাব পুরো দ্বীনের যে বুনিয়াদি মূলনীতি, তার ব্যাপারে আমাদেরকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়। ওয়াহীর জ্ঞান কে সুসংহত করার চেষ্টায় আমাদের ফকীহ ঈমামদের ভূমিকাও একি রকম গুরুত্তপূর্ণ। তারা আমাদের জন্য ওয়াহীর জ্ঞান,সাহাবী রাঃ দের করা কুরআনের তাফসীর, আমল, তাদের ইজমা, আরবী ভাষার জ্ঞান ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে অনেক বিষয়ের ফিকহ লিপিবদ্ধ করেছেন যেন আরব বা অনারব সাধারণ মানুষকে কুরআন হাদীস ঘেঁটে ঘেঁটে প্রতিটি মাসআলা নতুন করে উদ্ভাবন করতে না হয়। আল্লাহ্ আমাদের চার মাযহাবের ঈমাম রঃ সহ সকল ঈমামদের আখিরাতে উত্তম প্রতিদান দিন।
উপরের অনুচ্ছেদে কুরআন, হাদীস এবং ফিকহ এর জ্ঞান সংকলনের ইতিহাসের একটি ছোট সারাংশ লিখার চেষ্টা করেছি। এটি এই মহান এবং অপরিহার্য জ্ঞানের হক আদায় করার জন্য যথেষ্ঠ নয়। আজকের ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের যুগে, মুসলিমদের কে এই ইতিহাস পড়ার ব্যাপারে আগ্রহী করা খুব মুশকিল। লোকেরা আমার মতন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেদের নিবন্ধ পড়ে আর জুমার খুতবা এবং দ্বীনী দারস গুলোর খণ্ডিত ৫ মিনিটের অংশবিশেষ দেখা ও তাতে মন্তব্য করাকে দ্বীন চর্চা করা হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাই দেখা যায়, মুসলিমদের লিখাই সব চাইতে কম দলিল নির্ভর আর অনুভূতিপ্রবণ। অথচ, ইসলাম দাড়িয়ে আছে ওয়াহীর জ্ঞানের দলীল এবং সনদের উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে খ্রিষ্টান ও ইহুদী ধর্ম বিকৃত হয়ে গেছে তাদের নবীদের আ : ওয়াহীর জ্ঞানকে সংরক্ষণ না করতে পারায়।
এমনি একটি অনুভূতিপ্রবণ লেখা ‘যে কারণে হানাফিই রয়ে গেলাম!’ (নিচে লেখাটি দেওয়া আছে বাদামী রঙে) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফরওয়ার্ড হতে হতে আমার কাছে এসে পড়েছে যা মানুষকে আমাদের পূর্বসুরী ঈমামদের সংকলিত জ্ঞানকে অবজ্ঞা করে কেবল সমাজে জ্ঞান হিসেবে প্রচলিত যা আছে, তাকেই হক মেনে নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়। এইখানেই শেষ নয়। লেখাটিতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে জ্ঞানের চর্চাকারীদের কে ভুল এবং সন্দেহের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে এমন করে দেখানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। আমি চেষ্টা করব, সেই মুসলিম ভাইয়ের লেখা ভুলগুলো অপনোদনের। আল্লাহ্ তার ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত ভুল গুলো ক্ষমা করে দিন।
লেখাটি শুরু হয়েছে আহলে হাদীস বা সালাফী দাওয়ার ব্যাপারে একটি সুপ্রচলিত ভুল সংজ্ঞা দিয়ে। সালাফ বা সৎকর্মশীল প্রথম ৩ প্রজন্মের মুসলিমদের কাছে (এর মধ্যে ঈমাম আবু হানীফা, ঈমাম মালেক ও আছেন কিন্তু। আল্লাহ্ তাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন) ইসলামের জ্ঞানের ব্যাপারে ফিরে যাওয়াকেই সালাফী দাওয়া বলে। সালাফী দাওয়া কখনোই ঈমামদের রেখে যাওয়া কাজকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে উৎসাহ দেয় না। আর সালাফী দাওয়াহ কোন দলের নাম নয় যে সেটাতে যোগদান করতে হবে। এটি একটি পদ্ধতি যেটি সাহাবী রাঃ এবং তাদের পরবর্তীতে আসা তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন রাও অনুসরণ করেছেন। এটি মোটেও বুখারী এবং মুসলিম শরীফের বাংলা অনুবাদ পড়ে তা থেকে নিজেই ফিকহী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া নয়। এরকম কেউ বলে থাকলে তা অবশ্যই ভুল এবং তা পুরো সালাফী দাওয়ার ভুল হিসেবে আরোপ করা যায় না। এরকম উদাহরণ কিন্তু আমরা আমাদের সমাজেও দেখি। যেমন তাবলীগের মুরুব্বিরা ওয়াজিব দায়িত্ব (যেমন সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর সন্তান প্রসবকালীন দায়িত্ব নিজের ছোট ভাই বা স্ত্রীর ভগ্নিপতির উপর চাপিয়ে দিয়ে, যারা কিনা গায়ের মাহরাম) ছেড়ে চিল্লায় যেতে নিষেধ করলেও অনেকেই তা করে থাকেন এবং সেটাকে ভুল হিসেবে দেখালে অন্যরা সেটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দাবী করেন। ব্যাপারটি সামগ্রিক ভাবে তাবলীগ জামাতের সমস্যা - এই কথা মেনে নিতে তারা রাজি হন না। একই রকম ভাবে সালাফী দাওয়াহ আরবী ভাষার জ্ঞান না রেখে কেবল সহীহ হাদীসের বাংলা অনুবাদ পড়ে ফিকহী সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর নাম নয়। উদাহরণ স্বরূপ, আজকের দিনে একজন হানাফী মুসলিম যদি এলাকার মসজিদে এমন একটি ইবাদত দেখতে পায়, যা সে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে আগত কোন বড়/শ্রদ্ধেয় আলেমকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে, এটি কোন সহীহ আমল নয়, বরং এটি কতিপয় জাহেলদের বানানো নবোদ্ভাবিত ইবাদত বা বিদআত যা হানাফী মাজহাব মোতাবেক ও শুদ্ধ নয়, তাহলে সেও এক রকম সালাফদের বা আমাদের সৎকর্মশীল ঈমামদের রীতিই অনুসরণ করলেন।
এরপর লেখাটিতে বিভিন্ন উদাহরণ এনে কেবল একটি মতামতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতা প্রমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি চেষ্টা করবো এই ভুল চিন্তাগুলো অপনোদনের। আল্লাহ আমাকে তৌফিক দান করুন।
লেখক বলেছেন সহীহ হাদীস মেনে ওযু এবং গোসলের ব্যাপারেই তিনি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি, নামাজের কথা তো আরো পরে! আসলে কি তাই? সালাফী দাওয়াহ কি মানুষকে সকল প্রচলিত জ্ঞান ত্যাগ করে প্রত্যেকের উপর নতুন করে বুখারী এবং মুসলিম শরীফ পড়ে ইবাদতের প্রতিটি বিষয়ে নতুন করে ফিকহী সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বলেছে? অবশ্যই না। এটি সালাফি দাওয়াহ এবং ইসলামের সমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডারের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে অনীহা তৈরির একটি দেশীয় পদ্ধতি যা অন্যায় ভাবে ব্যবহার করা হয়। অবশ্যই বাসার বুয়া, কেয়ারটেকারদের মতন সুবিধাবঞ্চিত এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষ, ৭ বছরের শিশু অন্ধভাবে তাদের কাছে যিনি জ্ঞানের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য (যেমন এলাকার মসজিদের ঈমাম, সন্তানদের জন্য তাদের দ্বীনদার বাবা, চাচা, মামা, অথবা এলাকার দ্বীনদার ব্যক্তি), তাদেরকেই অনুসরণ করবে। কিন্তু সমস্যা হল লেখক এবং এই ধরণের মতাদর্শ ধারণকারী মুসলিম ভাইরা পুরো মুসলিম জাহানের সকল ব্যক্তিকেই কাজের বুয়া, কেয়ারটেকার অথবা ৭ বছরের বাচ্চার সমমানের মনে করেন। মনে হয় যেন বাংলাদেশ অথবা আরো বড় পরিসরে এই ভারতীয় উপমহাদেশে যা কিছু প্রচলিত তাই হানাফী মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত। অথচ এটিও হানাফী মাযহাবের উপর দেওয়া একটি অপবাদ।
লেখক বলেছেন, কোনটা মেনে ওযু করবো? ছোট একটা জিনিসই ধরি। কিছু জায়গায় অঙ্গ দুবার করে ধোয়ার কথা বলা আছে, কিছু জায়গায় তিনবার, কিছু জায়গায় একবার। আমি যদি দুবার করে ধৌত করি তাহলে একটা সহীহ হাদিস আমি মান্য করছিনা, তিন বার ধুলে অন্য আরেকটি সহীহ হাদিস মান্য করছিনা।
এই ধরণের হাদীসগুলোকে আমাদের দেশে এমন ভাবে ব্যবহার করা হয় যেন কুরআন হাদিস শিক্ষার ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা নিরুৎসাহিত হয়। যেন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিও কেবল হাতে গোনা কয়েকটি বই পড়ে বা অন্যের নিকট থেকে শুনে দ্বীনের ব্যাপারে কাজের বুয়া, কেয়ারটেকার বা ৭ বছরের বাচ্চা হিসেবে সারা জীবন পার করে দিতে পারে। উপরের ইটালিক অংশটিতে লেখক ওযুর ব্যাপারে রাসূল সাঃ আমাদের জন্য যে সহজতা এনেছেন , সেটাকেই তিনি হাদীসের কারণে তৈরী বিভ্রান্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। এই অংশটুকু পড়ে মনে হবে রাসূল সাঃ আমাদের চরম সন্দেহপূর্ণ এবং অস্পষ্ট একটি দ্বীনের উপরে রেখে গেছেন; সাহাবী রাঃ গণ রাসূল সাঃ থেকে ওযুর ব্যাপারে এক এক জায়গাতে এক এক বর্ণনা দিয়েছেন। মনে হবে, পরবর্তী আলেমরা এসে আসলে জ্ঞানকে সংকলন করেন নি, বরং পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। নাউযুবিল্লাহ! সত্যি কথা বলতে কী এই হাদীস গুলো থেকে আলেমরা (একজন নির্ভরযোগ্য হানাফী আলেম ও এই কথায় বলবেন) বুঝেছেন - ওযু তে অঙ্গগুলো ৩ বার ধোয়া যেমন সুন্নত, ২ বার ধোয়াও কোন দোষের নয়, তাও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। পানির প্রাপ্যতা এবং সময় কতটা বাকি আছে (যেমন ঈমাম সালাতে দাঁড়িয়ে গেছেন এমন অবস্থায়) মুসল্লিরা দুইবার ধুয়ে ওযু সম্পন্ন করে সালাতে সামিল হলেও পরিপূর্ন সওয়াব পাবেন। এই রকম হাদীস গুলো আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে প্রশস্ততা শেখায়, সংকীর্ণতা নয়। এই যে ফিকহ তা বললাম, এটাও যে হাদীস পড়ে আমার বা আপনার বুঝতে হবে তা নয়। এই ফিকহী সিদ্ধান্ত গুলো ঈমামগণ লিপিবদ্ধ করেছেন। একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন আসতে পারে যে এতো গভীরে ঢুকে আমাদের কী লাভ? এটি আরো একটি ভুল চিন্তা। যেমন একজন ব্যক্তি ৩ বার করে ধুয়ে নামাজে সামিল হতে গিয়ে তাকবীরে তাহরীমা পেলোনা। অথচ সে যদি জানতো ২ বার ধুলেও সুন্নাহ পালন হয়ে যায়, তাহলে সে তাকবীরে তাহরীমা ইমামের সাথে পেত।
লেখক বলেছেন, তিনি কাজের বুয়া, কেয়ারটেকার বা ৭ বছরের বাচ্চাদেরকে কি রেফারেন্স সহ ওযুর হাদীস বা ফিকহ পড়াবেন কিনা। অবশ্যই না। কিন্তু ফিকহ বলে দেওয়ার পর ওযু সম্পর্কিত হাদীসটি শোনানো হলে স্বল্পশিক্ষিত মানুষ ও মুগ্ধ হবে এই ব্যাপারে যে সাহাবী রাঃ গণ কত গভীরভাবে রাসূল সাঃ এর প্রতিটি কাজ খেয়াল করতেন ! সাহাবীদের রাঃ প্রতি তখন তাদের ভালোবাসা বাড়ে; দ্বীন পালনে তারা আগ্রহী হয়। সত্যি কথা বলতে কি এই হাদীস পড়াকে লেখক ভাইও সমর্থন করেন, কিন্ত সেটা তার পছন্দের সংকলিত গ্রন্থ থেকে; তবে বুখারী বা মুসলিম থেকে নয়। আবারো উল্লেখ করছি, সালাফী দাওয়াহ কোনভাবেই স্বল্পশিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের হাদীস পড়ে ফিকহ প্রতিপাদন করতে বলেনা। স্বল্পশিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তার সমাজের সব চাইতে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে অনুসরণ করবে। এক্ষেত্রেও তারা অন্ধ নন। একজন জর্দা খাওয়া অপরিষ্কার দাঁতের সুন্নতি লেবাসধারী জ্ঞানহীন ব্যক্তির থেকে দ্বীনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে নাকি রাসূল সাঃ এর মতন দাঁতের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে (যিনি মৃত্যুর আগেও মিসওয়াক করছিলেন ) সাবধান, আখলাকে নমনীয় একজন দ্বীনি আলেম থেকে দ্বীন শিখবে সেই ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব এটুকু বিচার বিবেচনা অন্তত সবারই করতে হবে।
লেখক বারবার বুঝাতে চেয়েছেন, হাদীসের সহীহ, যঈফ বা জাল হওয়া একটি অমীমাংসিত বিষয় এবং এই ব্যাপারে মুহাদ্দিসরা আধা খেচড়া কিছু কাজকরে গেছেন। অথচ ৪ মাজহাবের ঈমামদের মধ্যে ২ জনেরই হাদীসের সংকলন আছে। এবং হাদীস শাস্ত্রের একটি অন্যতম শাখা ইলমুল রিজাল বা হাদীস বর্ণনাকারী ব্যক্তির ব্যাপারে সংকলিত তথ্য থেকেই মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ব্যাপারে তাদের রায় দিয়েছেন। তাই যখন একজন মুহাদ্দিস কোন হাদীসের ব্যাপারে তার রায় দিচ্ছেন, সেটা তিনি পূর্বের সংকলিত জ্ঞানের উপর নিজের গবেষণা থেকে বলেন, তিনি নতুন কিছু রচনা করেন না। লেখক পরোক্ষভাবে এটাও বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন সালাফী দাওয়াহ মানেই নাসিরুদ্দিন আলবানীর অন্ধ অনুকরণ। এটি আরেকটি ভুল ধারণা। সালাফী দাওয়াহ কখনোই পূর্ববর্তী আলেমদের বাদ দিয়ে কেবল নাসিরুদ্দিন আলবানীর কথা অনুসরণ করতে বলেনা। আধুনিক যুগের সমস্যা গুলো যেহেতু আগের যুগে ছিলোনা ; যেমন একটা কাফির দেশে স্থায়ী ভাবে নাগরিকত্ব নেওয়া, দুনিয়াবী কোন বিষয়ে একজন ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যেখানে মেয়েরাও পড়বে এক সাথে - এসব বিষয়ক প্রশ্নের জন্য আমরা আধুনিক যুগের আলেম (গত শতাব্দীতে চলে যাওয়া ) দের কথা নিয়ে আসি। এর অর্থ এই নয় যে, আগের আলেমদের প্রত্যাক্ষান করা হচ্ছে। নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ কিছু হাদীসের ব্যাপারে আগের মুহাদ্দীসদের সাথে দ্বিমত করেছেন ; কিন্তু তার সংখ্যা খুবই নগন্য। এইখানে উল্লেখ করা গুরুত্বপুর্ণ যে তিনি তার এই মতামত একেবারে শুরু দিকের মুহাদ্দিসদের রেখে যাওয়া সনদ, রাবীদের নিয়ে আলোচনা থেকে তার মতামত দিয়েছেন- একেবারে সম্পূর্ণ নতুন করে কিছু আবিষ্কার করেন নি। নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ এর নামাজের বইটিও সংকলন মাত্র। তিনি সেখানে নিজের কোন নতুন মতামত দেননি। নামাজের মধ্যে প্রচলিত ভুলগুলো শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে অবশ্যই তিনি ভুলের উর্ধে নন , তা কেউ দাবীও করেনি।
লেখক উম্মাহের আলেমদের ঐকমত্যের একটি বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এই বলে যে, কারো কারো মতে বুখারী সব চেয়ে সহীহ, কারো মতে মুয়াত্তা ইমাম মালিক। তার মানে কেউ কেউ এমন ও বলেছেন বুখারী তেমন সহীহ নয়। এটি হাদীস শাস্ত্র, এর সংরক্ষণের ব্যাপারে অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ন জ্ঞানপ্রসূত মন্তব্য। তার এই অনুচ্ছেদ দেখে মনে হয়েছে রাবীদের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ইখতিলাফই যেন ৯০ ভাগ। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি ভুলে গেছেন আমাদের চার মায্হাবের ইমামগণ ও রাবীদের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্যতা, সনদের অখণ্ডতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে তাদের কাছে থাকা হাদীস গুলো থেকে ফিকহী সিদ্ধান্ত টেনেছেন। কিছু সনদের এবং রাবীর ব্যাপারে মুহাদ্দীসদের মতানৈক্য আছে। কিন্তু সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন ভাবে দেখানো যেন নিজেদের এলাকায় প্রচলিত ফিকহের ব্যাপারে সবাইকে খুশি করা যায় - এই চেষ্টা বড় ধরণের কপটতার শামিল। এটি সেই শুরুতে উল্লেখ করা সালাফী দাওয়ার ব্যাপারে ভুল ধারণা ছড়িয়ে লোকজনদেন দ্বীনের জ্ঞানের ব্যাপারে অশিক্ষিত রাখার চেষ্টা মাত্র।
লেখক বারবার বলেছেন সালাফী দাওয়াহ মানেই ফিকহ নতুন করে উদ্ভাবন করার। এটি স্পষ্ট করার প্রয়োজন যে সালাফি দাওয়াহ নতুন করে ফিকহ উদ্ভাবনের দাওয়াত দেয় না, বরং মানুষকে ঈমান এবং আমল সংশোধন, হালাল হারামের জ্ঞান সমৃদ্ধ করে জীবনে বাস্তবায়নের কথা বলে; এবং এই জন্য জ্ঞানের উৎস হিসেবে সাহাবী রাঃ এবং তাদের পরবর্তী ২ প্রজন্মের করে যাওয়া কাজকে প্রাধান্য দিতে বলে। সাধারণ মানুষ আলেমদের অনুসরণ করবে; তবে একজন আলেমকে নয়; আলেমদের সাহচর্যে থেকে ফিকহ গুলোর হিকমত জানবে, কোরান ও হাদীস এর পটভূমি জানবে। সাধারণ মানুষ আলেমদের বিচার করবেনা, বরং ফিকহ গুলোর ব্যাপারে যদি প্রশস্ততা থাকে, তবে সেটা জেনে আমল করবে- যেমন উপরে উল্লেখ করা ওযুর উদাহরণটির মতন।
সালাফী দাওয়াহর ব্যাপারে আরেকটি অভিযোগ হল, এটি মানুষকে বেছে বেছে সুবিধাজনক ফাতওয়া নিতে উদ্বুদ্ধ করে। এটিও কিছু অল্পসংখক মানুষের ভুল কাজ যা পুরো দাওয়াহর উপরে দোষ হিসেবে আরোপ করা হয়। আমি ওযুর উদাহরণটি আবার নিয়ে আসি। একজন যদি অফিসে থাকাকালীন সময়স্বল্পতার কারণে একজন আলেমকে জিজ্ঞেস করে ওযুতে দুইবার করে অঙ্গ ধুয়ে সম্পন্ন করেন, তাহলে তো তিনি কোন দোষের কিছু করলেন না। তবে, সালাফি দাওয়াহর বিরোধীরা বেশির ভাগ সময় বিয়ে বা তালাক সম্পর্কিত উদাহরণ নিয়ে আসেন। যেমন: তারা বলেন সালাফীরা তালাক দিয়ে এমন কোন একটা মায্হাবের মত নিবে যেন তালাক না হয়; ফলত তারা ওই বৈবাহিক সম্পর্কে জীবন যাপন করে যা বৈধ নয় । দ্বীনের ব্যাপারে সচেষ্ট কোন ব্যক্তি এরকম করবে বলে মনে হয়না; এগুলো কেবল বানানো গল্প যেন লোকেরা সালাফী দাওয়াহর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়। এরকম গর্হিত কাজ কেবল কিছু কপট লোকই করতে পারে যে ব্যক্তিগত জীবনে একটি মাযহাব অনুসরণ করে; কিন্তু তালাকের পর সে অন্য মাজহাবের মত খুঁজতে থাকে বিয়ে রক্ষা করার জন্য। এটাকে আধুনিক যুগে ফাতওয়া শপিং বলে। এটাকে কখনোই সালাফি দাওয়াহ সমর্থন করেনা। তালাকের মত বিষয় হাদীস কোরআন ঘেটে সাধারণ মানুষ বের করবে- এটাই সালাফী দাওয়াহ যেন প্রচার করে —এমনটাই আমাদের দেশে প্রচার হয়ে আসছে। এটি সর্বৈব মিথ্যা। বরং, অবশ্যই একজন নির্ভরযোগ্য কোরআন সুন্নাহর আলেমদের শরণাপন্ন হতে হবে। লেখকের হয়তো প্রধান সাহাবীরা যেসব এলাকায় গিয়েছিলেন বা ছিলেন সেসব জায়গায় নামাজ সম্পর্কিত সব হাদিস ছিল। এই ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার কাছে কুফায় বা ইমাম মালিকের কাছে মদিনায় নামাজ সংক্রান্ত সব হাদিস ছিল। এই ক্ষেত্রে তারা এসব বেছেই নামাজের নিয়ম বানিয়েছেন। ওই নিয়ম ফলো করতে আপত্তি কোথায়? এই অংশটিতে হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাসের ব্যাপারে তার জ্ঞানের স্বল্পতা ফুটে উঠে। উনি ধরেই নিচ্ছেন সব সাহাবী সব হাদীস জানতেন। সত্যি কথা বলতে কি তিনি সীরাত ও যে বিশেষ পড়েন নি, তা স্পষ্ট। একাধিক ঘটনা আছে সীরাতে যেখানে আবু বকর এবং ওমর রাঃ এর মতন বড় সাহাবী অন্য সাহাবীদের কাছে জানতে চেয়েছেন, এই ব্যাপারে তারা রাসূল সাঃ থেকে কিছু জানেন কিনা; (উদাহরণ: মীরাস বন্টনের বেলায় আবু বকর রাঃ এবং সিরিয়াতে প্লেগ হওয়া কালীন ওমর রাঃ এর সেখানে যাওয়া) এবং নামাজ বিষয়ক হাদীস গুলোর বেলায়ও এই কথা সত্যি। নামাজের এতগুলো সুন্নত আমল আছে যে প্রতি সাহাবী রাঃ, যারা দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই সব গুলো হাদীস জানতেন - এটি ইতিহাস এবং সীরাত নিয়ে অজ্ঞানতা প্রসূত মন্তব্য ছাড়া কিছুই নয়। সমস্যা এখানেই যে একজন সাহাবীর রাঃ সবগুলো হাদিস না জানাকে তার শানের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করা। এটি একটি অস্বাভাবিক প্রত্যাশা এবং এই একই প্রত্যাশা লোকেরা আমাদের শ্রদ্ধেয় ঈমামদের উপরও দিয়েছে। এটা কি হতে পারে তাদের সবার জ্ঞান একই ছিল (জানার ব্যাপারে) অথচ তারা ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিয়েছেন? এটা কখনোই হতে পারেনা। বরং তারা তাদের প্রাপ্ত জ্ঞানের সাথে সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে সর্বোত্তম উপসংহারে পৌঁছাতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন।
লেখক শেষ করেছেন ইয়াকুব আ: এর সাথে তার পুত্রদের কথোপকথন দিয়ে এবং এটাকে তার জন্য দলীল হিসেবে নিয়েছেন। অথচ ইয়াকুব আ : এর ছেলেদের জন্য তাদের বাবা, দাদা, দাদার বাবা সকলেই ছিলেন নবী। আমি নিশ্চিত যে লেখক উনার মুরুব্বিদের নবী জ্ঞান করেন না. তবে, উনি মনে করেন ইয়াকুব আ: এর ছেলেদের মতো তিনিও বাবা দাদার দ্বীন অনুসরণ করতে পারেন। অথচ ইয়াকুব আ : এর ছেলেরা অনুসরণ করছিলেন নবীদের রীতি, আর লেখক অনুসরণ করতে চাচ্ছেন উপমহাদেশীয় রীতি যার অনেকগুলো হানাফী মায্হাবেও উল্লেখ নেই; কেবল মুরুব্বিরা করেন বলে সেগুলো করা হয়; আর চাপানো হয় হানাফী মায্হাবের উপর।
লেখার শেষ ভাগে এসে আমি বলব, এক চরমপন্থা অন্য চরমপন্থার জন্ম দেয়। আমাদের দেশের হানাফী মাযহাব অনুসরণকারীরা কোরআন এর তাফসীর পাঠ, হাদীস পাঠ, সীরাত অধ্যয়নের ব্যাপারে এমনি বিরুদ্ধাচরণ করেছে যে আহলে হাদীস বা সালাফীদের মধ্যে একদল তার বিপরীত মেরুতে চলে গেছে- তারা বলে কোন আলেমই অনুসরণ করা যাবে না; নিজে হাদীস পরে বুঝতে হবে। আবারো বলছি সালাফী দাওয়াহ আলেমদের পরিত্যাগ করতে বলেন, বরং একজন আলেম ছেড়ে অতীতে চলে যাওয়া সকল আলেমদের (সাহাবী রাঃ, তাবেয়ীন, তবে তাবেয়ীন রহঃ, এবং তদপরবর্তী সকল ঈমামগণ ) কাছে জ্ঞান আহরণ করতে বলে পড়াশোনার মাধ্যমে। সকলকে আলেম হতে হবে না - তা ঠিক, কিন্তু সকলে সারা জীবন কেবল কাজের বুয়া, বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার বা ৭ বছরের বাচ্চার সমান জ্ঞান নিয়ে চলবে এমনটাও ভ্রান্তি। আল্লাহ সকলকে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের তৌফিক দেন করুন।
এভাবে তো ভাবি নাই
যে কারণে হানাফিই রয়ে গেলাম ! ছোট বেলা থেকে না জেনেই হানাফী মাজহাব পালন করে বড় হয়েছি। নামাজ শিক্ষার যে বই গুলি বাসায় ছিল - সব ছিল নিউজপ্রিন্টের। ভিতরে খালি মাসআলা ছিল। কুরআন হাদিসের কোন রেফারেন্স ছিলোনা। ছিল ব্র্যাকেটে ফতোয়ায়ে আলমগিরির রেফারেন্স। যা কি জিনিস জানতাম না।
বড় হলে আহলে হাদীস ও সালাফিদের বই পড়লাম। কুরআন ও হাদিসের প্রচুর রেফারেন্স দেয়াতে খুব ভালো লাগলো। তারা বললো: তুমি এসব মাজহাব ছাড়। সহীহ হাদিস মেনে ইবাদত করো। অন্ধ তাকলীদ করো না।
হানাফীরা ইমাম আবু হানিফা ও অন্যন্য মুকাল্লিদরা অন্যন্য ইমামদের ফিকহ মানে, এর চেয়ে সহীহ হাদিস মানো । একটু এক্সট্রিম কেউ কেউ তাকলীদকে শিরক বললো, বললো বুদ্ধি থাকলে তাকলীদ করতে হবে কেনো। এরকমই আরো কিছু কথা সুন্দর সুন্দর কথা ।
আমার কথা গুলো বেশ মনে ধরলো। হানাফী থেকে আহলে হাদীস ইচ্ছা জাগলো । মাজহাবের তাকলীদ বাদ দিয়ে সহীহ হাদিসের উপর আমল করার ইচ্ছা জাগলো। হাতে টাকা ছিল - জোগাড় করলাম সিহাহ সিত্তাহ, বাংলা-আরবী। আরবী স্কিপ করে বাংলায় সহীহ হাদিস পড়া শুরু করলাম।
কিন্তু ওযু ও গোসল অধ্যায়ই শেষ করতে পারলাম না। নামাজ তো আরো পরে। রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর ওযুর বিভিন্ন ধরণের বর্ণনা আছে। কোনটা মেনে ওযু করবো? ছোট একটা জিনিসই ধরি। কিছু জায়গায় অঙ্গ দুবার করে ধোয়ার কথা বলা আছে , কিছু জায়গায় তিনবার, কিছু জায়গায় একবার। আমি যদি দুবার করে ধৌত করি তাহলে একটা সহীহ হাদিস আমি মান্য করছিনা, তিন বার ধুলে অন্য আরেকটি সহীহ হাদিস মান্য করছিনা।
প্রশ্ন ১: আমি এই যে কিছু সহীহ হাদিস মানতে যেয়ে অন্য সহীহ হাদিস মান্য করছিনা, সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে রেফারেন্স দিয়ে কেউ যদি বলে আমি সহীহ হাদিস মানিনা সেটা কি ঠিক হবে ? এর মানে কি আমি সহীহ হাদিস অমান্যকারী?
এখন আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি পড়ালেখা করেছি, বই পড়ার উৎসাহ আছে, ইসলামের প্রতি ঝোক আছে। এদের কথা ধরেন : আমাদের বাসার বুয়া বা বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার পড়াশোনা করতে পারেনা। আমার বন্ধু কয়েকজন যারা পড়ালেখা জানলেও ইসলামী বই অধ্যায়ন করেনা কারণ ইসলামের প্রতি আগ্রহ নেই । আমার ছেলে যার বয়স যখন ৭ হয়েছে। এদের কেউ ওযু পারেনা।
প্রশ্ন ২: তাদের কে শিখানোর জন্য যদি আমি যদি বুখারীর ও অন্যন্য হাদিস গ্রন্হের ওযু অধ্যায়ের সহীহ হাদিস গুলি সিরিয়ালি তাদের কাছে শুধু বাংলায় রিডিং পড়া শুরু করি, তারা কি সেগুলি বুঝে ঠিক মতো আমল করতে পারবে?
প্রশ্ন ৩: যদি তারা না বুঝে তাহলে তো আমাকে তাদের দেখিয়ে দিতে হবে কিভাবে ওযু করতে হয় । তখন আমি বুখারীর ও অন্যন্য হাদিস গ্রন্হের ওযু অধ্যায়ে উল্লেখিত বাংলা সহীহ হাদিস গুলি সমন্বয় করে বা সেখান থেকে বেছে নিয়ে আমার বুঝ অনুযায়ী তাদের শিখাবো। এতে কি তারা সহীহ হাদিস মানলো নাকি আমার বুঝ ও ব্যাখ্যা মানলো ? এই ব্যাখ্যাই কি ফিকহ না?
প্রশ্ন ৪: যখন আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি, তখন আমার হাদিসের টেক্সট ও রেফারেন্স দেয়া কি আমার জন্য জরুরি হবে ? বাস্তবেই কি তারা প্রত্যেকটির শিক্ষার পিছনের হাদিসের রেফারেন্স চাবে ? নাকি বলবে শুধু ওযু শিখিয়ে দাও ? এটি কি আমার উপর বিশ্বাস করে অন্ধ তাকলীদ করা নয় কি ? যদি রেফারেন্স দিয়েও দি তাও কি তারা সহীহ থেকে জাল হাদিস পার্থক্য করতে পারবে?
প্রশ্ন ৫:একটি হাদিস যে আমি সহীহ হাদিস কিভাবে বুঝছি? ব্র্যাকেটে লেখা আছে বলে। আমার সামর্থ্য নাই হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সহীহ যঈফ আলাদা করার। কেউ তাহকীক করে লিখে দিয়েছে। সেটাই চোখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছি। কেউ বুখারী অনুবাদ করে দিয়েছে, আমিও মেনে নিচ্ছি সেটা সঠিক অনুবাদ, কারণ আমার পক্ষে আরবি বুঝে অনুবাদের ত্রুটি ধরা সম্ভব না। এই তাহকীক ও অনুবাদ যে সঠিক মেনে নেয়া হচ্ছে সেটা কি অন্ধ তাকলীদ নয়?
প্রশ্ন ৬: ওযুর মতো অতি সহজ ব্যাপারে আমার যদি এই অবস্থা হয়, নামাজের মতো অতি জটিল ব্যাপারে কি আমার পক্ষে সহীহ হাদিস পড়ে নামাজ শিক্ষা করা কিভাবে সম্ভব? যদি আমার পক্ষেই সম্ভব না হয় আমার ৭ বছরের ছেলে কিংবা পড়ালেখা না জানা বুয়ার পক্ষে কিভাবে সম্ভব?
প্রশ্ন ৭: যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমাকে এমন একজনের আলিমের দারস্ত হতে হবে যিনি সব হাদিস পড়ে বুঝে আমাকে নামাজের নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দিবেন,তাইনা? হাদিস গুলির সমন্বয় করে যদি উনি ব্যাখ্যাই করেন তাহলে ফিকহ তো ফিকহই হয়ে গেলো । এই ক্ষেত্রে আমি কি সহীহ হাদিস মানছি নাকি ফিকহ? এই ফিকহ মানার মাধ্যমে আমি কি বাস্তবে আমি সমন্বয়কৃত সহীহ হাদিসই মানছি না?
প্রশ্ন ৮: আমি যদি আরেকজন আলিমের কাছে যাই এবং একই অনুরোধ করি হাদিস ঘেটে নিয়ম কানুন বানিয়ে দেয়ার জন্য । উনিও সব হাদিস ঘেটে আমাকে নিয়ম বানিয়ে দিলেন। প্রথম আলিমের নিয়ম গুলি আর দ্বিতীয় আলিমের নিয়ম গুলি কি হুবুহু একই হবে ? নাকি তাদের দুজনের সমন্বয় পদ্ধতি আলাদা হতে পারে?
একজনের কাছে এক হাদিস বেশি সহীহ অন্য জনের কাছে কম সহীহ লাগতে পারে না? দুজন একই হাদিসের অর্থ কে দুই ভাবে নিতে পারে? তারা কি আরবি ইবারত ভিন্ন ভাবে পড়তে পারেনা? হাদিসের শত শত কিতাবের উনি হয়তো কিছু পড়েছেন অন্যজন কিছু? রাবী দুর্বল কিনা এই নিয়ে ইখতেলাফ আছেনা? কারো কারো মতে বুখারী সব চেয়ে সহীহ, কারো মতে মুয়াত্তা ইমাম মালিক, এরকম অচেনা?
আরো কত কারণ আছে, হাদিস শাস্ত্র কি অংকের মতো যে রেজাল্ট একটাই হবে ? তাহলে দুজনেরই সহীহ হাদিস মানা সত্ত্বেও দুজনের নামাজের নিয়ম দুই ধরণের হতে পারেনা ? আমার কি সেই যোগ্যতা আছে যে আমি বলতে পারবো প্রথম জন বেশি ঠিক না দ্বিতীয় জন?
প্রশ্ন ৯: ধরেন আমি প্রথম আলিমের কাছে যাওয়ার পর উনি আমার অনুরোধে সকল হাদিস ঘেটে আমার জন্য নামাজের নিয়ম বানিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার ভাই যদি তার কাছে যেয়ে একই অনুরোধ করে তাহলে কি তিনি এই কাজটি হাদিস ঘাটার কাজটি কি আবার করবেন? নাকি আমাকে যে নিয়ম গুলি উনি দিয়েছেন সেগুলিই আমার ভাইকেও দিয়ে দিবেন? আমার ভাই আজ থেকে ১০ বছর পর গেলে একই নিয়মি তো পাবেন ওই আলিম থেকে তাইনা (কারণ যে হাদিস দেখে নিয়ম তৈরী করেছেন সেই হাদিস তো আর ১০ বছরে পরিবর্তন হয়নি)? ৫০ বছর পর কেউ গেলে? এখানে কি নামাজের নিয়ম পরিবর্তন হওয়ার খুব বেশি সুযোগ আছে ? ১৩০০ বছর পর ? নাকি প্রত্যেকবার শুরু থেকে হাদিস ঘাটতে হবে?
যদি পরে আমরা প্রথম আলিমের বের করা নিয়ম কে মাজহাব বা ফিকহে X ও দ্বিতীয় আলিমের বের করা নিয়ম কে মাজহাব বা ফিকহে Y নাম দি , তাহলে X ও Y ফলো করা কি ১৩০০ বছর পর হারাম হয়ে যাবে, যেখানে এটি ১৩০০ বছর আগে সহীহ ছিল?
প্রশ্ন ১০: নামাজ তো আর নতুন জিনিস না। এটি ইসলামের শুরু থেকে চলছে। তাহলে এই হাদিস ঘাটাঘাটি করে নামাজের নিয়ম বের করার কাজও তখন থেকেই হওয়ার কথা। তখন থেকেই যদি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বা ইমাম মালিক (রহঃ) বা ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বা ইমাম আহমদ (রহঃ) যদি এই হাদিস ঘাটাঘাটি করে নামাজের নিয়ম বের করার কাজটি করে গিয়ে থাকেন, নামাজের নিয়ম তো আর পরিবর্তন হয়নি, তাহলে এখন সেগুলি মানতে সমস্যা কোথায়?
ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেব এই যুগে এসে হাদিস ঘাটাঘাটি করে যে নিয়ম বের করেছেন তা ওগুলোর উপর প্রাধান্য পাবে কেন? ওই চার ইমামের কারো যোগ্যতা কি ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবের চেয়ে কম ছিল?
প্রশ্ন ১১: এখন যদি কেউ বলেন যে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর ওফাতের পর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় হতে পারে।
হয়তো প্রধান সাহাবীরা যেসব এলাকায় গিয়েছিলেন বা ছিলেন সেসব জায়গায় নামাজ সম্পর্কিত সব হাদিস ছিল। এই ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার কাছে কুফায় বা ইমাম মালিকের কাছে মদিনায় নামাজ সংক্রান্ত সব হাদিস ছিল। এই ক্ষেত্রে তারা এসব বেছেই নামাজের নিয়ম বানিয়েছেন। ওই নিয়ম ফলো করতে আপত্তি কোথায়?
অথবা, সাহাবীরা যেসব এলাকায় গিয়েছিলেন সেখানে নামাজ সম্পর্কিত সব হাদিস ছিলোনা, কিছু হাদিস ছিল। তাই কোনো এক এলাকায় যেমন ইমাম আবু হানিফার কুফায় কিংবা ইমাম মালিকের মদিনায় সব হাদিস ছিলোনা। পরে সব হাদিস একত্রিত হয়েছে। তাই সব হাদিস বাছাই করে বানানো ল্যাটেস্ট ইমাম আলবানী সাহেবের নামাজের নিয়ম বেশি শুদ্ধ।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে ওই সব এলাকায় আংশিক হাদিস থেকে বানানো আংশিক নামাজের নিয়ম পালন করে যদি সালাফ তথা তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈনরা শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম হয় তাহলে ওই আংশিক নিয়ম পালন করলে আমরা কেন ধরা খাব কিংবা সাওয়াব কম পাবো?
প্রশ্ন ১২: সুন্নাহর বিস্তার এর একমাত্র মাধ্যম কি হাদিস? এছাড়া কোন মাধ্যম নেই? ওযুর কথাই ধরুন না। যখন সাহাবীরা তাদের সন্তান বা তাবেঈদের ওযু শিক্ষা দিতেন তখন কি শুধু হাদিস বর্ণনা করতেন? নাকি হাতে কলমে নবীজির (দঃ) এর কাছ থেকে শেখা ওযুর মতো করে ওযু করে অন্যদের শিক্ষা দিতেন?
তাহলে তাবেঈ বা তাবেঈ-তাবেঈনদের সংস্পর্শে এসে প্র্যাকটিকাল নামাজ শিক্ষার পদ্ধতি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) কিংবা ইমাম মালিকের (রহঃ) বেশি জানার কথা নাকি ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবের। শায়খ আলবানীর কাছে তো শুধু হাদিস আছে, কিন্তু ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিকের কাছে হাদিসের সাথে সাথে প্র্যাকটিকাল শিক্ষাও তো ছিল। কার নামাজের নিয়ম বেশি শুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ?
প্রশ্ন ১৩:- ইমাম চতুষ্টয়ের বানানো নামাজের নিয়ম প্রায় ১৩০০ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ ফলো করে আসছে। উম্মাহর ইতিহাসের বাঘা বাঘা আলিম এগুলি মেনে নামাজ পড়েছেন। এমন সময় যখন ইসলাম দুনিয়াতে বিজয়ী ছিল, যখন মুসলিমদের ঈমান আমল ও ইখলাস বর্তমান মুসলিমদের চেয়ে বেশি ছিল। আর ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানীর তৈরী নামাজের নিয়ম অপেক্ষাকৃত অনেক কম মানুষ অনেক কম দিনের জন্য ফলো করছে, যখন মুসলিমদের ঈমান, আমল ও আখলাক সব চেয়ে নিচে। প্রথমোক্ত গ্রূপের বহু মুসলিমদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি নাকি দ্বিতীয় গ্রূপের কম মুসলিমদের?
প্রশ্ন ১৪: কুরআনে বলা আছে শুধু মাত্র বাপ্ দাদারা করতো বলে কোন কিছু করা উচিত না। কিন্তু তা কি মুশরিক বাপ্ দাদাদের ব্যাপারে বলা হয়নি? বাপ্ দাদা যদি মুসলিম হয় তাহলে তো তাদের মান্য করতে কোনো দোষ আছে?
যেমন নবী ইয়াকুব (আঃ) মৃত্যুর সময় তার পুত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন তারা তার পরে কার ইবাদত করবে। তার ছেলেরা উত্তর দিয়েছিলেন তাদের বাপ্ দাদাদের উপাস্যের। বাপ্ দাদা সঠিক রাস্তায় থাকলে সেই রাস্তা দিয়ে হাটা যাবেনা এমন কথা কি বলা আছে? নূহ (আঃ) এর ছেলে যদি এই যুক্তি দিত যে বাপ্ দাদা মেনে আসছে বলে আমরা মানবোনা এটা কি সঠিক হতো?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে সালাফী হতে দিলোনা।
আমি হানাফীই থাকলাম। এবং মন ভরে দুআ করলাম সেই সব আলিমদের যারা আমাদের জন্য নিজেদের সারা জীবন বিলিয়ে দিয়ে সহজ ফিকহের কিতাব লিখে গিয়েছেন, যা মাত্র ১০০/২০০ টাকা দিয়ে কিনে কিংবা আলিমের সোহবতে শিখে আমল করে আমরা অমূল্য অফুরন্ত অনিঃশেষ জান্নাতের জন্য কাজ করতে পারি। বিশেষ দ্রঃ ইমামে আজম আবু হানীফা রহ. একজন তাবে’ঈ ছিলেন।
আবু আঈশা