ওয়াসিয়াহ বনাম মীরাস
সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানা তাআলার। দরুদ ও সালাম নাযিল হোক তার রাসুল (সা:) এর উপর।
এই লেখাটি আমাদের দেশের মুসলিম সমাজে প্রচলিত একটি ভুল ধারণা অপনোদনের জন্য। আল্লাহ আমাকে এ কাজের তৌফিক দান করুন। মুসলিম পরিবারগুলোর অনেকেই ওয়াসিয়াহ এবং মীরাস কে সমার্থক মনে করেন। অথচ শরীয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। ওয়াসিয়াহ হলো মানুষের জীবদ্দশায় পালনের জন্য একটি জরুরী সুন্নাহ। মানুষ মৃত্যুর পূর্বে তার ঘনিষ্ঠজনদের (যাদের উপর তিনি দায়িত্বশীল) জন্য কুরআন সুন্নাহর আলোকে কিছু উপদেশ রেখে যেতে পারেন অথবা কোন বিশেষ অনুরোধ রেখে যেতে পারেন। যেমন: “আমার লাশ যেন তাড়াতাড়ি দাফন করা হয়” অথবা “অন্যত্র নিয়ে যাওয়া বা কারো অপেক্ষার কারণে যেন দাফনে বিলম্ব না করা হয়” ইত্যাদি। এছাড়া, একজন মুসলিম তার সম্পদের অনধিক এক তৃতীয়াংশ দান বা উপহার (আমরা অনেকে একে হেবা বলে জানি) করে দিতে পারেন। তবে, এই ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন এই দান বা উপহার যেন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কারো জন্য না হয়। তবে কোন সন্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে তাকে কিছু হেবা করতে গেলে অন্য উত্তরাধিকারীদের মতামত নিয়ে করা উচিত যেনো কারো এমন অভিযোগ না থাকে যে তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে। তবে মৃত্যুর পূর্বে সন্তানদের কিছু উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে সমতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ (কিছু আলেম মীরাস এর নিয়ম অনুযায়ী ভাই বোনের উপহারের অংশ নির্ধারণ করতে বলেছেন অর্থাৎ ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ)
এই তিনটি কাজই- যা ওয়াসিয়াহর মধ্যে পড়ে, তা মৃত্যুর পূর্বে করতে হয়। যদিও এটি ওয়াজিব নয়,তবে মুহাম্মদ সাঃ থেকে এই ব্যাপারে জোর তাগিদ এসেছে।
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি ওয়াসিয়াহ করার মত সম্পদ কোন মুসলমান ব্যক্তির নিকট থাকে তবে নিজের নিকট ওয়াসিয়াহনামা লিখে না রেখে সেলোক যেন দুই রাতও অতিবাহিত না করে। - সহীহ, ইবনু মা-জাহ (২৬৯৯),বুখারী, মুসলিম
প্রত্যেক মুমিনের উচিত ওয়াসিয়াহ রেখে যাওয়া। সম্পদ দান করতে না পারলেও অন্তত মূল্যবান উপদেশ রেখে যাওয়া যেতে পারে যা সন্তান-সন্ততি এবং পরিবারের সদস্যদের বিপদের সময় দ্বীনি দিকনির্দেশনা দিবে।
এইবার আসি মীরাস বিষয়ে। আমরা খুব অল্প ক’জনই হয়তো জানি মীরাস বা উত্তরাধিকার প্রয়োগ হয় কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর। একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে তাঁর কোন সন্তান যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে ওই ব্যক্তির (পিতা) মৃত্যুর পর তার মীরাস এর মধ্যে তার মৃত সন্তান অন্তর্ভুক্ত হয় না। এটিই শরীয়াহ। অনেকে এটিকে বেমানান বা অন্যায় বলতে পারেন। কিন্তু ওই মৃত সন্তানের পরিবারের জন্য (যদি থাকে) হয় তার পিতার জীবদ্দশাতেই কিছু ওয়াসিয়াহ করতে পারেন অথবা তার ভাই বোনেরা সম্পত্তি বন্টনের সময় তাদের মৃত ভাই বা বোনের পরিবারকে সর্বসম্মতিক্রমে কিছু দিতে পারেন। তবে এটা বোঝা খুবই জরুরী যে মীরাস মৃত্যুর পূর্বে লিখে যাওয়ার বিষয় নয় যেমনটা অন্যান্য ধর্মের লোকেরা করে। এই ভুল কাজের ফলে মৃত্যু পরবর্তী সময়ে মীরাস বন্টনের ব্যাপারে জটিলতা তৈরি হয়। বিশেষত, যখন উত্তরাধিকারের দ্বাবিদার দের কেউ আগেই মারা গিয়ে থাকে অথবা ওয়াসিয়াহ এর নামে অন্যায় ভাবে সব সম্পদ কয়েকজনকে লিখে দেয়া হয়। এছাড়া, মৃত্যুর পূর্বে সম্পদ বন্টন করে দেয়ার এই রীতি সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়। যেমন: বাবা-মা যদি তাদের সম্পত্তি থেকে যখন কোন ওয়াসিয়াহ করতে চান (অনুর্ধ এক-তৃতীয়াংশ) তখন সম্ভাব্য উত্তরাধিকারদের কাছে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়। এটা অনেকটা পরের ধনে পোদ্দারি করার মতন। এমনকি, এসব ক্ষেত্রে বাবা-মার সাথে অসদাচরণ করতেও অনেকে পিছপা হয় না।এর একমাত্র কারণ হল উত্তরাধিকার বা মীরাস নিয়ে ভুল জ্ঞান - একজন মানুষের বয়স হলেই বা কর্মক্ষমতা চলে গেলেই মীরাস কার্যকরী হয়ে যায়। সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের নিয়ম ভঙ্গ করে ওয়াসিয়াহ করার কারণে নিকটাত্মীয় বা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে রেষারেষি এবং বিদ্বেষ ও তৈরি হয়।
মুসলিম পরিবারগুলোতে এই বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে । এই জন্য প্রশ্নোত্তর পর্বগুলোতে এই বিষয়ক প্রশ্ন দেখা যায় প্রচুর। সবাইকে অনুরোধ থাকলো শায়খ মঞ্জুর এ এলাহীর এই বিষয়ক দারস টি শুনার।
এছাড়া আমি নিচে মূল ধারণা গুলো তুলে ধরলাম। এগুলোর ব্যাপারে ধারণা এবং জ্ঞান পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। ওয়াসিয়াহ হলো
- মৃত্যুর পূর্বে অনূর্ধ্ব এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ এমন কাউকে দেওয়া যে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে এর পেছনে কোন উত্তরাধিকারকে বঞ্চিত করার নিয়ত থাকলে তা হারাম বলে গণ্য হবে।
- এছাড়াও ওয়াসিয়াত উপদেশবাণী হতে পারে পরিবারের সদস্যদের জন্য যেন মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তারা দ্বীনের উপরে অটল থাকতে পারে।
- একজন ব্যক্তি তার কাছে গচ্ছিত আমানত এবং ব্যক্তিদের প্রাপ্য ঋণের কথা ও তার ওয়াসিয়াহ এ লিখে যেতে পারেন যেন তার উত্তরাধিকারীরা এই সম্পদ প্রকৃত দ্বাবিদারদের এর কাছে ফেরত দিতে পারে।
অন্যদিকে
- মীরাস মৃত্যুর পূর্বে বন্টন করার ব্যাপার নয়। একজন ব্যক্তি কেবল এটুকু বলে যেতে পারেন যে উত্তরাধিকার বন্টনের সময় কোন ব্যক্তি বা পরিবারের কোন সদস্য থেকে তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে পরামর্শ নিতে পারে।
- এবং অবশ্যই কারো মৃত্যুর পূর্বে তার উত্তরাধিকারীরা তার সম্পদের মালিক হয়ে যায় না। অতএব ওই ব্যক্তির ওয়াসিয়াহর এর ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের কোন বক্তব্য থাকা উচিত নয় যদি তিনি সেটা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই করে থাকেন।যেমন: একজন ব্যক্তি যদি আল্লাহর রাস্তায় তার সম্পদের কিছু অংশ দান করে যেতে চান, সেই বিষয় থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে তার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের কোনরকম চাপ প্রয়োগ করা ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহ আমাদেরকে তার দিনের উপরে অটল থাকার তৌফিক দান করুন এবং প্রচলিত ভুল ধারণা বসত আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে অসদাচরণ করা থেকে রক্ষা করুন।
আবু আঈশা