গায়েবের বিষয় এবং ওয়াহীর জ্ঞানের উপর বিশ্বাস
গায়েবের বিষয় এবং ওয়াহীর জ্ঞানের উপর বিশ্বাস : আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতাপ্রসূত কিছু প্রশ্নের উত্তর
প্রতি আরবি বছরের এই সময়ে কয়েকটি বিষয়ে উম্মাহর মধ্যে কিছু সন্দেহের অবতারণা হয় এবং এসব নিয়ে প্রশ্ন চলে পৌনঃপুনিক ভাবে। এই প্রবণতার পিছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখতে আমার এই লেখা।
📌১. আল্লাহ প্রতি রাতে শেষ আকাশে নিচে নেমে আসলে পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় রাত হয়, তাহলে কি উনি সব সময় নিচেই থাকেন ?
📌২. লায়লাতুল কদর কি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে হতে পারে? সেটা কী করে সম্ভব?
📌৩. সূর্য কিভাবে আল্লাহর আরশের নিচে সিজদায় গিয়ে আবার উদিত হওয়ার অনুমতি খোঁজে?
📌৪. আমাদের সমাজে নিচের প্রশ্নটি খুব কম চোখে পড়লেও এটি বেশ প্রচলিত।
তামীম আদ দারী রাঃ থেকে বর্ণিত দাজ্জালের হাদীস (যেটি জাস্সাসার হাদীস বলে পরিচিত) এবং নিচের হাদীসের সাথে সমন্বয় করতে না পেরে জিজ্ঞেস করা দাজ্জাল কি এখনো জীবিত আছে? ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘উমার (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের শেষের দিকে আমাদের নিয়ে ‘ইশার সালাত আদায় করলেন। সালাম ফিরানোর পর তিনি দাঁড়িয়ে বললেনঃ তোমরা কি এ রাতের সম্পর্কে জান? বর্তমানে যারা পৃথিবীতে রয়েছে, একশ বছরের মাথায় তাদের কেউ আর অবশিষ্ট থাকবে না। (সহীহ বুখারী; ১১৬)
এই প্রশ্নগুলো নিয়ে কিছু মুসলিমকে দেখবেন বছরের পর বছর ঘুরছেন; বিভিন্ন আলেমকে একই প্রশ্ন করছেন এই আশায় যে কেউ না কেউ তার পক্ষে কিছু বলবেন; আর তিনি (প্রশ্নকারী) তার বিদ্যমান চিন্তার সাথে ইসলামকে মানিয়ে নিতে পারবেন; নিজেকে পরিবর্তন না করেই। চলুন দেখা যাক এই প্রবণতার মূল কোথায়?
অনেক বছর আগে একটা খুৎবাতে শুনেছিলাম - দোয়া করার ক্ষেত্রে সাধারণ একটি ভুল হলো আল্লাহর উপর মানবীয় সীমাবদ্ধতা আরোপ করে এরপর তার কাছ থেকে কিছু চাওয়া। যেমন ধরুন, একজনের ক্যান্সার হয়েছে এবং ডাক্তাররা তাকে কোন আশার বাণী শোনাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় তিনি যদি আল্লাহর কাছে সুস্থতা চাওয়ার ক্ষেত্রে ভাবতে থাকেন, “ ক্যান্সার রোগী কি আর কখনও সুস্থ হয়? তারপর ও দোয়া করি, হয়ত আমার সওয়াব বৃদ্ধি পাবে।” - তাহলে এটি হবে দোয়ার আদব পরিপন্থী; কেননা তিনি অনুমান করছেন বা দৃঢ় ধারণা পোষণ করছেন যে আল্লাহ সুবহানা তাআলার পক্ষে ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব নয়। আমাদের চারিপাশে খেয়াল করলে দেখবেন এই জ্ঞানবিবর্জিত অনুমান বা ধারণা কেবল আল্লাহর ব্যাপারেই নয়, আমরা এই চিন্তা ধারাকে ওয়াহীর ব্যাপারেও প্রয়োগ করেছি। ওয়াহী দুই ধরনের; ওয়াহী এ মাতলু (কুরআন) এবং ওয়াহী এ গায়ের মাতলু (হাদীস)। এই দুইটি ওয়াহীর মাধ্যমে আমাদের কাছে যে দিক নির্দেশনা এসেছে সেটা কিয়ামত পর্যন্ত এবং এমন কী অনন্তকাল পর্যন্ত সত্য- কারণ যার কাছ থেকে এটি এসেছে, তার কাছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল জ্ঞান আছে। প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের মধ্যে হয়তো প্রথম ধরনের ওয়াহীর (কুরআনের ) ব্যাপারে কম সন্দেহ দেখা যায়; কিন্তু হাদীসের মাধ্যমে যে সত্যগুলো আমাদের কাছে এসেছে, সেগুলো আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত কলুষিত চিন্তা চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হলেই আমাদের মনে প্রশ্ন আসে। সন্দেহজনক প্রশ্ন অবশ্যই আলেমদের দেয়া প্রশ্ন উত্তর বা বই থেকে নিরসন করা চাই; কিন্তু সমস্যা বাধে যখন একই প্রশ্নের আবর্তে একজন মুসলিম আটকে যান এবং তার সাথে ওয়াহীর জ্ঞানকে অস্বীকার করেন বা নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।
ঈমানের ৬ টি স্তম্ভের সবকয়টিই গায়েবে বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। এই ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করতে হবে ওয়াহীভিত্তিক এবং ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের বুঝ অনুযায়ী। সেই জ্ঞান অর্জনের একটি নিয়মতান্ত্রিক ধারা আছে এবং সকল মুসলিমেরই উচিত দ্বীন পালনে দৃঢ়চেতা হওয়ার পর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে ওয়াহীর জ্ঞানের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে নিজেকে একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষিত করে তোলা এবং যেকোন রকম সন্দেহের নিরসন করা। কিন্তু সেটা সাধারণত হয় না। তাই আমরা গায়েবের ব্যাপারে খবর দেয়া হাদীসগুলোকে নিয়ে বারবার সন্দেহের আবর্তে ঘুরতে থাকি। আমি এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনার ভুলটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করব। এই উদাহরণ আমি শুনেছি অনেক বছর আগে তাকদীরের উপরে দেয়া একজন আলেমের দারসে। উদাহরণ টা এরকম:
আমরা মানুষেরা ত্রিমাত্রিক (three dimension) একটি পৃথিবীতে থাকি। আমরা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা/ গভীরতা দিয়ে physical world দেখতে পারি বা অনুভব করি। অন্য কোন মাত্রা বা ডাইমেনশন এলেই আমরা আর বুঝতে পারি না। এই ব্যাপারে আমরা যদি কিছু মানুষকে কল্পনা করি যারা দ্বিমাত্রিক অর্থাৎ এরা কেবল দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ অনুভব করতে পারে, তাহলে দেখতে পাব তারা কিভাবে আমাদের (আমরা যারা স্বাভাবিক মানুষ) কাজকর্মগুলোকে অতিপ্রাকৃতিক মনে করে। ধরুন, দ্বিমাত্রিক এই মানুষগুলোর মধ্যে একজনের হৃদপিন্ডে একটি জমাট রক্ত আছে। সেটি সার্জারি করতে গিয়ে এই দ্বিমাত্রিক মানুষগুলোর কয়েকজন ডাক্তার একত্রিত হলেন। তারা প্রস্থচ্ছেদ বরাবর জমাট রক্তটি সরানোর প্রচেষ্টা শুরু করবেন ; ঠিক এমন সময় আমাদের মতন একজন ত্রিমাত্রিক মানুষ ডাক্তার গিয়ে ওই জমাট রক্তটি সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসলেন (উচ্চতা/ গভীরতার মাত্রায়)। তখন ওই দ্বিমাত্রিক সার্জনেরা দেখবে জমাট রক্তটি অদৃশ্য হয়ে গেছে; কেননা তারা উচ্চতা বা গভীরতার মাত্রায় কিছু দেখতে পায়না, বা অনুভব করেনা; তাদের কাছে মনে হবে অতিপ্রাকৃতিক কিছু ঘটেছে। আদতে তারা তাদের ডাইমেনশন এর বাইরে কিছু হচ্ছে বলে সেটা বুঝে উঠতে পারছেনা। ঠিক এমনটি ই হয় আমাদের বেলায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে যে যেটা আমরা দেখতে পাই না, সেটার অস্তিত্ব নেই।
এই উদাহরণের পরে এইবার আমাদের স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরে আসুন। চিন্তা করে দেখুন, আমরা ও কেবল ত্রিমাত্রিক পৃথিবীর চিন্তা চেতনায় আল্লাহর যেই সিফাত এবং কাজগুলো জ্ঞান ওয়াহীর মাধ্যমে আমাদের নিকটে এসেছে, সেগুলোকে বুঝার চেষ্টা করি, যেটি সালাফদের রীতি নয়। এই বিষয়গুলোকে কুরআন সুন্নাহতে যেভাবে এসেছে, ঠিক সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে, কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়।
আমি কয়েকটি মন্তব্য করে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তরগুলোর লিংক দিয়ে দিচ্ছি। আমার দ্বীনি ভাইবোনদের প্রতি অনুরোধ - আপনারা পড়বেন এবং প্রশ্ন থাকলে একজন আলেমের সাথে মুখোমুখি বসে সেটা সুরাহা করবেন। অলসতা বা “আমি তো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত; উনারা আমাকে কী বুঝাবেন” বলে অহংকারবসত এই সন্দেহের নিরসন না করে বসে থাকবেন না।
🤔দেখুন আমরা কি কখনো চিন্তা করি আল্লাহ আমাদের মতন শুনেন বা দেখেন? অবশ্যই না। তিনি এই পৃথিবীর সকল মানুষের সব কথা (প্রকাশ্যে এবং গোপনে) এবং বাকি সকল মাখলুক কে শুনছেন একই সময়ে । এইটা কীভাবে সম্ভব সেটা কি কখনো আমরা (বিশ্বাসীরা) প্রশ্ন করি? না, আমরা করি না; কারণ আল্লাহ তার নিজের ব্যাপারে বলেছেন, “তিনি আকাশসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে যুগল সৃষ্টি করেছেন, চতুস্পদ জন্তুদের মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন জোড়া, এভাবেই তিনি তোমাদের বংশধারা বিস্তৃত করেন, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সব শোনেন, সব দেখেন।” (সূরা ৪২, আয়াত ১১) অথচ আমরা উনার নিচের আকাশে নেমে আসা নিয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে থাকি। একবার ভাবিনা, এই তথ্য আল্লাহর কাছ থেকে ওয়াহী এর মাধ্যমেই এসেছে, তাই এতে আমাদের যে দোয়া কবুলের খবর এসেছে, সেটা নিয়েই আমাদের ব্যস্ত হওয়া উচিত, সেটা কীভাবে হবে তা নিয়ে নয়।
🤔হাদীস শাস্ত্রের বিশাল ভান্ডার এবং এর সাথে সম্পর্কিত জ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলো; যেমন ইলমুল রিজাল; নিয়ে অমুসলিম অনেক মনীষীদের হইচইয়ের অন্ত নে। অথচ হাদীসের ভাষ্য নিয়ে প্রশ্নকারীদের দেখা যায় হাদীস সংকলনের মূলনীতি এবং একাধিক হাদীসের মধ্যে বাহ্যত বৈপরীত্য থাকলেও তাদের সমন্বয় করার প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির ব্যাপারে তারা নূন্যতম জ্ঞানহীন।
🤔এছাড়াও আরেকটি সাম্প্রতিক বিষয় মুসলিমদের দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে বিমুখ করেছে। সেটা হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবেগী বক্তাদের বক্তব্য; যাদের কথা শুনে মুসলিমরা মনে করে জ্ঞান অর্জন এবং সে অনুযায়ী আমল আমাদের অবস্থা পরিবর্তনের মূল চাবি নয়; দ্বীনের উপর ইস্তিকামাত জরুরি নয়; বরং বেশি বেশি পোস্ট শেয়ার করে নিজেদের জীবন অপরিবর্তিত রাখলেই পরিবর্তন চলে আসবে। কারণ দোষারোপ করার জন্য মুসলিমদের একটি অংশকে নির্ধারণ করে নিয়েছি আমরা। আল্লাহ বলছেন, “…… আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তাদের অবস্থা পরিবর্তন করে।…….” (সূরা: ১৩, আয়াত ১১)। খেয়াল করে দেখবেন , আমরা মুসলিমরা ততদিন পৃথিবীতে নেতৃত্ব দিয়েছি, যতদিন আমরা দ্বীনের উপর দৃঢ় ছিলাম; যতই দ্বীনের জ্ঞান কমেছে, ততই বেড়েছে সন্দেহ, বেড়েছে অন্য মতবাদের প্রতি ভালোবাসা, দুর্বল হয়েছে আমাদের দূর্গ আর আমরা হয়েছি শত্রুদের সহজ শিকার।
আল্লাহ গায়েবের জ্ঞানের ব্যাপারে আমাদের সন্দেহের নিরসন করুন এবং আমাদের পূর্নশক্তিতে পৃথিবীর নেতৃত্বে ফিরিয়ে দিন।
Can You Catch Laylat Al-Qadr Twice in One Ramadan? - Islam Question & Answer
Understanding how the Sun Prostrates to Throne & things way above our paygrade - Assim Al Hakeem
আবু আঈশা
৩০ রামাদান ১৪৪৫