যুহুদের সেকাল আর একাল
আজ থেকে প্রায় বছর ত্রিশেক আগের কথা। আমি তখন শৈশব আর কৈশোরের মাঝামাঝি বয়সে। আমাদের চট্টগ্রামের বাসাটা মেট্রোপলিটন এলাকায় হলেও এখনকার সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটা মফস্বলেই হবে। আর চট্টগ্রামের নতুন অংশ হওয়ার সুবাদে পুরান ঢাকার মতন আমরাও এখন পুরান চট্টগ্রাম। তখন ভিক্ষুকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গেটের কড়া নাড়ত। আমাদের বাসায় একটা ছোট উঠানের মতন ছিল; তারপর ধাতব গেট। কলিং বেল ছিলোনা তখনো। কেও ওখানটায় আওয়াজ করে ডাকলে আমি দৌড়ে খুলতে যেতাম, এটাই একটা বিনোদন ছিল । ভিক্ষুক হলে চাল দেওয়া হত অথবা ভাংতি পয়সা। আর দিনের কৌটা পূর্ন (আমার মায়ের একটা আন্দাজ) হলে আম্মা বলতেন বলে দে মাফ করতে। আমার এই কাজ খুব পছন্দের ছিল। একদিন দুপুরে বাইরের গেটে কেউ এসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে গেটের নিচ দিয়ে দেখলাম ক্ষয়ে যাওয়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর ধূলি মাখা লুঙ্গি। আমি আর জিজ্ঞেস না করেই মাকে বললাম, ‘আম্মা, ভিক্ষুক আসছে। কী বলব?’ মাফ করতে বলার দিক নির্দেশনা পেয়েই আমি লোকটাকে চলে যেতে বললাম। কিছুক্ষন পর দেখি সে তখন ও দাঁড়িয়ে গেটের কড়া নাড়ছে। আমি গেট খুলে প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ; এতো দেখি আমার একজন রক্তসম্পর্কের আত্মীয়। তিনি খুব নির্বিকার। আমি ভিতরে আসতে বললাম। আমি আমার মা কে জিজ্ঞেস করে কখনো উত্তর পাই নি কেন একজন টাইটেল পাশ করা কওমী ঘরানার আলেম সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এরকম জীর্ণ পোশাক ব্যবহার করেন। আমার মা আমাকে উত্তর দিতে পারতেন না। ঠিক একই রকম ভাবে আমাদের এলাকার প্রায় প্রতিটা মসজিদে একজন সুফী থাকত (আমরা চাটগাইয়া ভাষায় বলতাম সুই সাব ). এরা পরিবার থাকলেও তেমন বাসায় যেতেন না। ময়লা কাপড় পড়তেন, মসজিদে পড়ে থাকতেন, অনেক ধীরে ধীরে সালাত পড়তেন আর সালাতে জিকির করার মতন ভঙ্গি করতেন। এরা রমজানে ইতিকাফ করে সামাজিক কৌটা পূর্ণ করতেন। আমি অনেক বছর পর যখন দ্বীনের জ্ঞানের সন্ধান পেয়েছি, তখন বুঝেছি এই লোকগুলো যুহুদ কে বুঝেছেন সুফিবাদের মতন করে। আমরা সাহাবীদের মধ্যে দেখেছি (সিরাহ গ্রন্থ এবং হাদীস থেকে) , তাদের কম সংখ্যক জামা থাকলেও তারা সব চাইতে ভালো টা পড়ে সালাতে যেতেন। আর যখন ওমর রাঃ বা অন্যান্য সাহাবী রা: তালি দেওয়া জামা পড়তেন, সেটা সত্যিকার অর্থেই অভাবের কারণে নতুন পোশাক না কিনতে পারার কারণে । রাসূল সাঃ থেকে এরকম নির্দেশনা আমাদেরকে দেওয়া হয় নাই যে আমাদের ইচ্ছে করে ছেঁড়া এবং নোংরা জামা পড়তে হবে কেবল যুহুদ ভিত্তিক জীবনের জন্য। যুহুদ এর অর্থ নিয়ে আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আমরা এটিকে জীবনের বিভিন্ন অংশে আমাদের ইচ্ছেমতো বাস্তবায়ন করছি।
উপরের উদাহরণ টি দিলাম এই জন্য যেন আমরা পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করে একই ভুলে পতিত না হই। অথচ, একই রকম ভুলের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ঠিক যেই অতি সাবধানতার জন্য উপমহাদেশের একজন আলেম গত শতাব্দীতে ইফতার ৩ থেকে ৪ মিনিট দেরি করে করার ফাতওয়া দিয়েছিলেন, আমি দেখছি আমাদের যুবকেরা সেই একই আলোচনা এখন নতুন করে শুরু করছে। আলেমরা জ্ঞানের আলোকে বলা সত্ত্বেও অতি গবেষণা করছি আমরা। নিচে আরো কিছু ভুল পদক্ষেপ উদাহরণ হিসেবে দিচ্ছি যেগুলো আমরা অনেকেই যুহুদ ভেবে করছি, কিন্তু এগুলো যুহুদ নয়। যুহুদের সংজ্ঞা জেনে নিতে এই লিংকে যেতে পারেন। এর মূল অংশ আমি এই লিখার শেষে দিয়ে দিচ্ছি।
আরেকটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। এর সাথে অনেক অভিভাবকের সাম্প্রতিক একটি অভিযোগের মিল রয়েছে। একবার এক বুয়েট ছাত্রের অভিভাবক এসে এনাম চাচাকে বললেন (উত্তরা হালাকায় ২০১৩-২০১৪ এর দিকে হয়ত), তার সন্তান দ্বীনের দাওয়াত পাবার পর একাডেমিক পড়া নিয়ে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। তিনি খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। তখন এনাম চাচা বললেন, ‘সেই ছেলের উচিত বুয়েট থেকে বের হয়ে যাওয়া। যদি এইখানে পড়াশোনা করা তার প্রয়োজন মনে না হয়, তাহলে তার বের হয়ে অন্য কিছু করা উচিত।’ একজন মুসলিম একটা সুবিধা নিয়ে তার থেকে যেই প্রত্যাশা (মুবাহ কাজ ), সেটা পূর্ণ না করে অলস জীবন যাপন করা তার জন্য সমীচীন নয়। একই রকম ভাবে আমাদের অনেক বাবা মা ধরে নিয়েছেন যুহুদের অর্থ হল আমার ছেলে মেয়ে পড়া শোনা তেমন করবেনা। দ্বীনদার হলেই চলবে। এই ভাইবোনদের কাছে পড়াশোনা করা একটা অলংকারিক বিষয়, না করলেও চলবে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি ভালো ফলাফলের জন্য কোন ভাবেই অসদুপায় অবলম্বন করা যাবেনা।আর অনেকেই বুঝে নিয়েছি ভালো ফলাফল করার আর চেষ্টাই করা যাবেনা। মেয়েদের ক্ষেত্রে আমরা আরো আজব পদক্ষেপ নিয়েছি। অবাধ মেলামেশার স্কুলে বাচ্চাদের না পড়ানোর জন্যই আমাদের ইসলামিক স্কুল গুলোর প্রতিষ্ঠা (SCD এর উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে এটি একটি) . এখন যদি আমরা আমাদের মেয়েদের সর্বনিম্ন শিক্ষার ব্যাপারেও অনাগ্রহ তৈরী করি এই কথা বলে যে , ‘তোমার পড়াশোনা করার প্রয়োজন নাই, বিয়েই তো দিয়ে দিব। ’ তাহলে আমাদের জন্য সমূহ বিপদ আছে। আমি তাড়াতাড়ি বিয়ের বিপক্ষে বলছিনা। কিন্তু আমরা কি সেই কওমী ঘরানার লোকেদের মতোই করছি না , যারা তাদের মেয়েদের বুনিয়াদি শিক্ষা টুকুও না দেওয়ার কারণে একটি বড় প্রজন্ম এমন মা পেয়েছিলো যারা ভাবতো ইসলাম কেবল তাদের জন্য, কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের ইসলামের উপর বড় করতে পারেনি??? মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা বাহুল্য। সেটা মেয়ের স্বামীই নির্ধারণ করবে, আদৌ সে পড়বে কিনা। কিন্তু স্কুল কলেজ পর্যন্ত আমাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে আমরা কেন এতো উদাসীন হব, সেটা পরিষ্কার নয়। এটা কী করে যুহুদ হতে পারে তাও বোধগম্য নয়। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বুনিয়াদ ভালো না হলে আমাদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে কী করবে? ব্যবসা বলি বা অন্য পেশা, কোথাও কি আছে যেখানে দুনিয়াবী পড়ার মূল্য নাই? আমরা কি তাদেরকে মানুষের কাছে হাত পাততে হয় মত করে রেখে যাব? অবশ্যই রিজিক আল্লাহের হাতে। এবং আমরা জিপিএ ৫ পাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে ও সামিল হতে বলছিনা। কিন্তু, আমরা আল্লাহের জন্য যেকোন কাজই সুন্দর করে করার চেষ্টা করব। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক কাজই মুবাহ কাজ, এগুলো ইবাদত নয়। আমাদের হয় জীবিকার জন্য করতে হয় অথবা অন্য উদ্দেশ্যে। ইবাদত সংশ্লিষ্ট না হলে অন্য যেকোন কাজ যাচ্ছেতাই ভাবে করব, এটি যুহুদ নয়।
দুনিয়া থেকে যথাসম্ভব প্রয়োজনের বেশি না নেয়া এবং স্বেচ্ছায় জোরপূর্বক নিজের পরিবারের উপর দারিদ্র চাপিয়ে দেওয়া ভিন্ন বিষয়। এই বিষয়েও আমি দেখেছি অনেকেই দরিদ্র হওয়ার প্রতি জোর দিচ্ছেন। সম্ভবত বাচ্চাদেরকে পড়াশোনার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা এরই একটি ফসল। এক সময় আমরা লোকেদের দাওয়াত দিতাম পড়াশোনা নিয়ে অতি টানা হেচড়া করে সুপার মুসলিম বানানোর প্রতিযোগিতায় না শামিল হওয়ার জন্য; এখন হচ্ছে তার উল্টো। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা জীবনের অনেক স্তরে আমাদের সংজ্ঞার যুহুদ বাস্তবায়ন করতে চাইলেও এই পর্যন্ত খাওয়া দাওয়াতে যুহুদ করতে চায় এমন কাউকে আমি অল্পই দেখেছি। এ থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায় আমরা যুহুদ কে বুঝি নি।
যুহুদের অর্থ এটা নয় যে আমি চালচুলো নেই, এমন কারো কাছে খোঁজ খবর না নিয়ে আদরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিবো। রাসূল সাঃ এর একটি বিখ্যাত হাদীস যেটিকে আমরা গীবতের আলোচনাতে নিয়ে আসি যে বিয়ের ব্যাপারে সমালোচনা বৈধ, সেখানেও রাসূল সাঃ: ওই মহিলা সাহাবীকে বলেছেন দু দুই জন সাহাবীকে বিয়ে না করতে পরামর্শ দিয়েছেন - একজন মারধর করে আরেকজন খাওয়াতে পারবেনা।
যুহুদের অর্থ এই নয় যে বাবা মা সারাদিন দাওয়াতী কাজে ব্যস্ত থাকবে অনলাইনে আর সন্তানের পড়াশোনার বেলায় বলব, ‘দুনিয়াবী পড়াশোনা করে কী লাভ?’ আর, অনেকেই এই কাজটি কেবল নিজের স্ত্রীর দিকে চালিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সন্তানের আদব কায়দা, আখলাক নির্মাণে বাবা চাচাদের ভূমিকা অনেক। সকল বড় আলেমগণ - পরিবারে সন্তানের শিক্ষায় সময় ব্যায় করা বাবা মায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে উল্লেখ করেছেন।
আমাদের জীবনে অনেক বেশি আভিজাত্য; সেটা মানতেই হবে। কিন্তু সেটা খুব দ্রুত ঠিক করতে গিয়ে আমরা আরেক চরম পন্থার দিকে ঝুকে পড়ছি। আল্লাহ আমাদের কে সকল চরম পন্থা থেকে রক্ষা করুন। সকলের প্রতি অনুরোধ রইল নিচের অংশটুকু পড়ার। রামাদানের সময় রক্ষার্থে তাড়াহুড়ো করে লিখলাম। কোন ভুল হলে ক্ষমা করবেন।
যুহুদের সংজ্ঞা আখিরাতমুখীতা এবং দুনিয়া থেকে বিমুখ হওয়ার বিষয়টি ইসলামী শরীয়তে যেভাবে আমরা বিবেচনা করে থাকি বা যেভাবে আমরা উল্লেখ করে থাকি ব্যাপারটি আসলে এমন নয়। আখিরাতমুখীতা বা আল্লাহমুখীতাকে ইসলামী শরীয়াতে “আয যুহুদ” বলা হয়ে থাকে। কেউ কেউ আয যুহুদকে তাসাউফ এর সাথে মিলিয়ে ফেলেছেন যেটি সঠিক নয়। তাসাউফ এবং “আয যুহুদ” দুটি ভিন্ন বিষয়।
“আয যুহুদ” হচ্ছে কোনো ব্যক্তি আখিরাতকে প্রাধান্য দিবে দুনিয়ার কর্মকাণ্ড বা ব্যস্ততার উপর। এ বিষয়ে ‘আলিমগণের কিছু মতামত আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন, ইমাম সুফিয়ান আস সাওরী (র.) বলেন, الزهد هو قصر الأمل “যুহুদ হচ্ছে নিজের আশাকে অধিক লম্বা না করে সীমিত করা”। সুতরাং যত বেশি আল্লাহর বান্দা তার আশা বা ইচ্ছা বা মনের কামনাবাসনাকে সংক্ষিপ্ত করতে পারবেন ততই তিনি যুহুদ করতে পারবেন। এ বক্তব্য ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (র.) ও যুহুদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। মাদারিফুস সলেক্বীনের মধ্যে ইবনুল ক্বাইয়ূম (র.) শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া থেকে উল্লেখ করেছেন যেটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সংজ্ঞা الزهد هو ترك ما لا ينفع في الآخرة “যে কাজটি আখিরাতের জন্য উপযোগী নয় সেটি পরিহার করা বা বর্জন করাই মূলত যুহুদ। যুহুদ বলতে এটা বোঝায় না যে আমরা দুনিয়াকে পরিহার করবো বা দুনিয়ার মাল বর্জন করবো। এটা মূলত যুহুদ না।” অনেকে এভাবে ধারণা করাতে আখিরাতমুখীতা বা দুনিয়াবর্জন করাকেই মনে করেছেন যুহুদ। তাই একদল লোককে দেখা যায় যারা তাসাউফ বা সুফিবাদে অথবা বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাস করে থাকেন তারা যুহুদকে এটিই মনে করে থাকেন যে দুনিয়াবিমুখ হয়ে আখিরাতমুখী হওয়া। দুনিয়াবিমুখ হয়ে আখিরাতমুখী হওয়াটি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থী। ইসলাম এই যুহুদের দিকে মানুষদেরকে উদ্বুদ্ধ করেনি।
আবু আঈশা